কথাটা সত্যি। বেশ দুযোগ বাইরে। রাস্তায় বাতিও নেই। মনসুর আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তবুও সে আসবে। আমি আমার অন্ধকার ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। মোমবাতি আছে, তবুও জ্বালাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কে যেন বলেছিল–প্রতীক্ষা করতে হয় অন্ধকারে। বোধহয় মিলনের প্রতীক্ষার কথা বলা হয়েছে। বসে থাকতে-থাকতে আটটা বেজে গেল। আমি প্রায় নিশ্চিত মনসুর আসবে না, তখন সে এল। গা দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ঝড়োকাকের মতো চেহারা, কাঁপছে ঠকঠক করে।
রিকশা দাঁড় করিয়ে এসেছি, চল।
মনসুরের বাসায় যেতে আমার ভালো লাগে না। সে নতুন বিয়ে করেছে, নতুন বৌরা স্বামীর বন্ধুদের সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এমন ভাব দেখায়, যেন স্বামীর বন্ধুদের জন্য খুব ব্যস্ত। মনসুরের বৌ সে-ভাটাও দেখায় না। সে স্পষ্টতই বিরক্ত হয়। সবাই তার বিরক্তি ধরতে পারে। মনসুর পারে না। উঠতে গেলেই মনসুর বলে, এত তাড়া কিরে, আরেকটু বস, আরেকটু বস।
মনসুরের স্ত্রী রীনা তীক্ষ্ণ কষ্ঠে বলে, বসতে বলছে, বসুন না।
মনসুর তাতে উৎসাহ পায়। হাসিমুখে বলে, রীনা আমাদের একটা গান শোনাও না। প্লীজ।
আজ না, আরেক দিন।
আহ্ শোনাও না। এই তোরা একটু রিকোয়েস্ট কর না। তোরা রিকোয়েস্ট করলে শোনাবে।
রিকোয়েস্ট করতে ইচ্ছে হয় না, তবু করতে হয়এবং এক সময় রীনা তী কণ্ঠে একটা রবীন্দ্রসংগীত শোনায়–আজি এ বসন্তে মাঘ মাসের দুর্দান্ত শীতে বসন্তের গান শুনে আমরা প্রশংসা করি। মনসুর দাঁত বের করে হাসে। এর বুদ্ধিশুদ্ধি এমনিতেই কম। বিয়ের পর আরো কমে গেছে। তার ধারণা হয়েছে, এরকম একটা ভাল বিয়ে পৃথিবীর আর কেউ করে নি। শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে তার উৎসাহ সীমাহীন। কেনটাকিতে তার স্ত্রীর এক ভাই থাকে। তাদের নতুন কেনা গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়ে পড়ে গেছে। এই নিয়ে মনসুরের চিন্তার শেষ নেই। অথচ সেভাইকে সে চোখেও দেখে নি।
কাটা দেখ, নতুন কেনা গাড়ি। সিক্স থাউজেন্ড ইউ এস ডলার দাম। অবশ্যি ইনসুরেন্স আছে। সব কভার করবে।
আমরা উৎসাহ না দেখালেও ক্ষতি নেই। মনসুর মুগ্ধ ভঙ্গিতে শ্বশুরবাড়ির গল্প করে যাবে, বুঝলি, আমার শ্বশুর সাহেবের ইচ্ছা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকা। গ্রামের বাড়ি হলে কি হবে, হুলস্থূল ব্যাপার। বাড়ির পিছনে আলিশান পুকুর। গত বৎসর তিন হাজার রুইয়ের পোনা ছাড়া হয়েছে। এর মধ্যেই এক হাত বড়ো হয়ে গেছে।
নির্বোধের মতত গল্প। শুনলেই অস্বস্তি হয়। তবু শুনতে হয়। হাসতে হয়। ভান। করতে হয় যেন খুব আগ্রহ বোধ করছি। রীনা বসে থাকে পাথরের মূর্তির মতো। তার চোখে-মুখে যাচ্ছিল্যের একটা ভাব। মনসুরের গল্পগুলি সে কী ভাবে গ্রহণ করে বুঝতে পারি না।
আজ অবশ্য রীনা খুব যতুট করল। তোয়ালে নিয়ে এল মাথা মোছর জন্য এবং আমাকে অবাক করে বলল, মাথা নিচু করুন, আমি মুছিয়ে দিচ্ছি। আমি আমার বিস্ময় গোপন করে বললাম, কোনো রমণীর কাছে আমি মাথা নিচু করি না। চির উন্নত মম শির।
রীনা একটু হকচকিয়ে গেল। আমি কথাবার্তা কম বলি, এরকম কিছু বলব আশা করে নি বোধ হয়। মনসুর উচু গলায় বলল, আজ আমাদের ম্যারেজ ডে।
তাই নাকি?
আরে গাধা, রীর ড্রেস দেখে বুঝতে পারছি না? বিয়ের শাড়ি। তুই আর আমি গিয়ে কিনলাম নগদ দুই হাজার টাকায়। টাকা শর্ট পড়ল, তোর কাছ থেকে নিলাম দু শ টাকা। মনে নেই কিছু?
শাড়ির এ ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ল না কেন? ঝড়-বাদলার দিনে কোনো মেয়ে তো এমন বেনারসী পরে ঘরে বসে থাকে না। ঘরে অবশ্যি ইলেকট্রিসিটি নেই, হারিকেন জ্বলছে। তবুও এ আলোতেও তো চোখে পড়া উচিত ছিল। মনসুর নিচু গলায় বলল, কেকের অর্ডার দিয়েছিলাম, সেটা আনতে গিয়েই দেরি হল। কেকের উপর লেখা থাকবে–শ্রীনার জন্যে। শালা শুওরের বাচ্চারা লিখেছে। মীনার জন্যে। যে লেখে সেই ব্যাটার জন্য অপেক্ষা করতে-করতে দেরি হল। শালা আর আসলই না। কাণ্ড দ্যাখ!
কেকটা আবার কেন?
রীনার ইচ্ছা, খাওয়াদাওয়ার পর কেক কাটবে। বয়স তত বেশি না, ছেলেমানুষ এখনো। নে, একটা সিগারেট খা। খাবার গরম করতে সময় লাগবে।
এখন অনেক কিছুই আমার চোখে পড়ছে না। এত বড় একটা কেকের বাক্স সঙ্গে ছিল, কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। আমি হালকা স্বরে বললাম, বিবাহবার্ষিকী-টার্ষিকী নিজেদের মধ্যে করতে হয়। আমাকে শুধু শুধু ডাকলি কেন?
মনসুর গলা ফাটিয়ে হাসল, যেন আমি খুব একটা হাসির কথা বলেছি। আমি বললাম, উপলক্ষটা বললে একটা কিছু আনতে পারতাম।
শালা তুই আবার আনবি কি? শুধু ফর্মালিটি।
মনসুর গভীর মনোযোগর সঙ্গে কেকের লেখা মীনাকে রীনা বানানর চেষ্টা করতে লাগল। রীনা এক বার জিজ্ঞেস করে গেল, চা দেব ভাই? খাবার দিতে দেরি হবে। একটা জিনিস ভাজতে হবে। কুমড়া ফুলের বড়া।
না, চা লাগবে না।
খান না একটু, আমিও আপনাদের সঙ্গে খাব।
ঠিক আছে, আনেন।
মনসুর গভীর হয়ে বলল, রীকে তুই আপনি-আপনি করিস কেন? তুমি করে বলবি। স্ট্রেইট তুমি।
আমি কিছু বললাম না। ওর এই বিচিত্র স্বভাব, বন্ধুবান্ধবকে সে তাদের দু জনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে চায়। এটা হবার নয়, তা বুঝতে চায় না।
আমি হালকা সুরে বললাম, আর কাউকে বলেছি?
নাহ্, শুধু তোকে। অনলি ইউ।
কেন, শুধু আমাকে কেন?
মনসুর তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি সহজভাবেই বললাম, তোর কি। ধারণা আমি আর ফিরে আসব না? মনসুরের মুখ কালো হয়ে গেল। এই কথাটি তাকে না বললেই হত। কেন বললাম?