এই ঘরটির উপর আমার মায়া পড়ে গেছে, দীর্ঘদিন থাকলাম এখানে প্রায় দু বছর। বত্রিশ বছর যদি আয়ু হয়, তাহলে জীবনের ষোল ভাগের এক ভাগ। বড়ো দীর্ঘ পরিচয়। দশ ফুট বাই আট ফুট এই কামরায় আর কি কোনো দিন ফিরে আসব? কত পরিচিত জিনিস চারিদিকে। কত কিছুই না আছে। লেজ নেই একটি বুডো টিকটিকি। এর কোনট সঙ্গী বা সঙ্গিনী নেই, এর পাশে অন্য কোনো টিকটিকি কোন দিন দেখি নি। আরো দুটি আছে তারা প্রেমিক-প্রেমিকার মতো একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। এই বুড়টির সাথীরা একে ছেড়ে গেছে।
বাথরুমে কুৎসিত একটা মাকড়সা আছে। সে শুধু কুৎসিত নয়–ভয়াবহ। তার পেটে চকচকে রূপালী একটা ডিমের থলি। এই থলি নিয়ে বেশির ভাগ সময়ই সে বেসিনের নিচে কোনো এক অন্ধকার কোণে লুকিয়ে থাকে। রাতদুপুরে হঠাৎ করে বেরিয়ে এসে আমাকে দারুণ চমকে দেয়।
আমার এ ঘরে একটিমাত্র জানালা। বেশ বড়োসড়োজানালা। তবে তেমন কিছু জানালা দিয়ে দেখা যায় না। শুধু পাশের ফ্লাটের অনেকখানি চোখে পড়ে। একটি বালিকাকে প্রায়ই দেখি বারান্দায় বসে আচার খাচ্ছে কিংবা বই পড়ছে। সুন্দর দৃশ্য। এই মেয়েটির উপরও মায়া পড়ে গেছে। সোমবারের পর এই চমৎকার দৃশ্যটিও হয়তো দেখা যাবে না।
জীবনের ষোল ভাগের এক ভাগ যেখানে কাটল তার উপর মায়া তো পড়বেই। পড়াই স্বাভাবিক। টাঙ্গাইলের এক হোটেলে এক বার সাত দিন ছিলাম। এমন মায়া পড়ে গেল। ছেড়ে চলে আসবার সময় বুক হু-হু করতে লাগল। চোখ ভিজে ওঠার উপক্রম।
আমি পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা টেনে নিলাম। একটু যেন শীতশীত করছে। তলপেটে ব্যথা শুরু হয়েছে।
সূক্ষ্ম একটা ব্যথা। মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি আছি। তোমার ভিতর বাস করছি। আমাকে ভুলে যাওয়া ঠিক নয়।
বাইরের রোদ নরম হয়ে আসছে। মেঘ জমতে শুরু করেছে। বর্ষা আসি-আসি করছে। এবার খুব জাঁকিয়ে বৰ্ষা আসবে। তার সাজসজ্জা টের পাওয়া যাচ্ছে। আমার ঘর থেকে আকাশ দেখা যায় না। কেন যেন মেঘ দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি উঠে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। আচার-খাওয়া সেই বালিকাটি রেলিং-এ হেলান। দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কৈশোরে এরকম একটা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। মেয়েটির নাম নীলিমা। তার বাবা নেত্রকোণা কোর্টের পেশকার ছিলেন।
সেই নীলিমাও খুব আচার খেত। ক্লাস নাইনে ওঠামাত্র নীলিমার বিয়ে হয়ে গেল। আমি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্যে রাত জেগে পড়ছি। বাবা রোজ এক বার করে বলছেন, ডিভিশন না পেলে জুতো দিয়ে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেব। নীলিমার বিয়ে আমাকে অভিভূত করে দিল। বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হল। রাতে বালিশে মুখ গুঁজে ভেউ ভেউ করে কাঁদলাম। বড়োআপ অবাক হয়ে বললেন, এই, তোর কী হয়েছে রে?
পেটে ব্যথা।
কোন জায়গায় ব্যথা দেখি?
আমি আরো শব্দ করে কাঁদতে লাগলাম। বড়োআপা মাকে ডেকে আনল। এবং দুপুররাতে মা আমার পেটে তেল মালিশ করতে লাগলেন। কৈশোরের সেই বিরহ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। আমি যথারীতি পরীক্ষা দিই এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটি লেটার নিয়ে ফাষ্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ি।
এই আচার-খাওয়া মেয়েটির সঙ্গে খুব সম্ভব নীলিমার কোন মিল নেই, তবু মাঝে মাঝে এই মেয়েটিকে নীলিমা ভাবতে ভালো লাগে। শুধু এই মেয়েকে কেন, পৃথিবীর সব বালিকাকেই আমার কাছে নীলিমা বলে মনে হয়।
টিপ টপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। আমি পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। তুমুল বৰ্ষণ হচ্ছে বাইরে। চারদিক অন্ধকার। ইলেকট্রিসিটি নেই। মনসুরের আসবার কথা চারটায়, বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে। নিচয়ই। দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি বারান্দায় হারিকেন জ্বালানর চেষ্টা করছেন করিম সাহেব। তাঁর ঘর থেকে শো-শোঁ শব্দ আসছে। কুকারে ভাত চড়িয়েছেন বোধ হয়। করিম সাহেব আমাদের মত হোটেলে খান না। নিজে রান্না করেন।
এই যে ফরিদ ভাই, আজ শরীরটা কেমন?
ভালোই।
ব্যথাট্যথা নেই তো?
জ্বি-না।
ঘুমিয়েছিলেন নাকি?
জ্বি। দেশ ভাসিয়ে দিয়েছে বৃষ্টিতে। ক্যাট্স্ এণ্ড ডগ্স্ যাকে বলে। চা খাবে, নাকি?
জ্বি-না, থাক।
আসেন আসেন, এক কাপ চা খান। চা সব সময় খাওয়া যায়।
করিম সাহেবের ঘরে গিয়ে বসতে হল। চাও খেতে হল। আজকাল লোকজন আমাকে খুব খাতির করছে।
অপারেশনের ডেট দিয়েছে?
জ্বি-না।
অপারেশন আজকাল ডাল-ভাত হয়ে গেছে। ভয়ের কিছুই নাই। তলপেটের অপারেশন তো ডাক্তাররা এখন চোখ বন্ধ করে বা হাতে করে। হা-হা-হা।
আমি চুপ করে রইলাম। পরিচিত-অপরিচিত প্রায় সবাই এখন আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, অপারেশনটা কত সহজ। আমার দিক থেকে তার কোন প্রয়োজন নেই। অপারেশন সহজ বা জটিলে কিছু আসে যায় না। করিম সাহেব চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বললেন, কত সিরিয়াস সিরিয়াস অপারেশন হচ্ছে। হার্ট, ব্রেইন। একেবারে ছেলেখেলা ব্যাপার।
তা ঠিক।
করিম সাহেব ভাত টিপে দেখলেন। তারপর বেশ আন্তরিকভাবেই বললেন, আজ চারটা ভাত খান না আমার সঙ্গে, খাটি গাওয়া ঘি আছে। বেগুনভাজা, গাওয়া ঘি। তার সঙ্গে শুকনা মরিচ ভেজে দেব। খারাপ লাগবে না।
আজ থাক। আরেক দিন খাব।
আজ অসুবিধা কী? বৃষ্টির দিন হোটেলে যেতে কষ্ট হবে। আসেন, দুজনে মিলে খাই।
আমাকে নিতে আসবে, এক জায়গায় খাওয়ার কথা আছে।
এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে নিতে আসবে কীভাবে?