টাইফয়েডের জন্যই হোক বা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক, বড়োআপার প্রতি তাঁর মমতা ছিল। এবং এটা এত বেশি পরিমাণে ছিল যে সবার চোখে পড়ত। এক বার ঈদের সময় বোনাস পেলেন না। বোনাস না পেলে ঈদের কাপড় হয় না, আমরা জানতাম। কাজেই আমরা বেশ সহজভাবেই পুরনো কাপড় লড়ি থেকে ইস্ত্ৰি করিয়ে আনলাম। নতুন কাপড় কিছুনা দেওয়াটা খারাপ বলে আমরা তিন ভাই তিন জোড়া মোজা পেলাম। নতুন মোজার সঙ্গে ম্যাচ করাবার জন্যে আমরা বুট পালিশওয়ালার কাছ থেকে জুতো পালিশ করিয়ে আনলাম। এক টাকা করে নিল প্রতি জোড়া।
ঈদের আগের রাতে দেখি বাবা বড়োনার জন্যে সাদার মধ্যে লাল ফুল আকা একটা ক্ষক নিয়ে এসেছেন। আমাদের কারো জন্যে কিছুই আনেন নি। এবং এজন্যে তাঁকে বিন্দুমাত্র লজ্জিত বা দুঃখিত মনে হল না। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জেদী হচ্ছে অনু। সে বলল, আমি ঈদ করব না।
বাবা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, তুই ঈদ না করলে ঈদ আটকে থাকবে? যত ফালতু বাত।
ঈদের দিন আমরা সবাই মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। বাবা বড়োআপার হাত ধরে নির্বিকার ভঙ্গিতে তাঁর বন্ধুদের বাড়িতে গেলেন। বড়োআপা ছাড়াও যে তাঁর আরো ছেলেমেয়ে আছে, তা বোধ হয় তিনি মনে করতেন না।
মনসুর চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ফাইন চাচা তেমন ফাইন নয়। কিন্তু মনসুর আজ সব কিছুতেই ফাইন বলবে। আলগা একটা ফুর্তির ভাব মুখের উপর ঝুলিয়ে রাখবে। খুব সম্ভব ওর ধারণা হয়েছে, হাসপাতাল থেকে আমি আর ফিরব না। ডাক্তাররা ওকে কিছু হয়তো বলেছে।
ফাসক্লাস চা হয়েছে রে। আরেক কাপ খাবি? না।
আমি একটা সিগারেট ধরালাম। অন্য সময় হলে সে ছোঁ মেরে সিগারেট নিয়ে ফেলে দিত। আজ কিছুই করল না। এসব ভালো লক্ষণ নয়। তাহলে কি ফেরার সম্ভাবনা একেবারেই নেই? ওয়ান-ওয়ে জানি?
পিজির যে ডাক্তার আমার অপারেশন করবেন, তাঁর কথাবার্তায় অবশ্যি সেরকম মনে হয় না। আমার ধারণা ছিল বুড়ো না হলে প্রফেসর হওয়া যায় না। কিন্তু এই ভদ্রলোকের বয়স মনে হয় চল্লিশও হয় নি। কানের কাছের কয়েকটি চুল শুধু পাকা। চমৎকার চেহারা। দেখে মনে হয় এই লোকটি রাগ করতে জানে না। চেচিয়ে কথা বলতে জানে না। মিথ্যা কথা বলতে পারে না। এ শুধু সবার সঙ্গে মজার মজার গল্প করে এবং ছুটিছাটা পেলেই ছেলেমেয়েদের হাত ধরে পার্কেটার্কে বেড়াতে যায়, বাদাম কেনে–কিন্তু বাদামের খোসাগুলি যেখানে-সেখানে ফেলে না, আধ মাইল হেঁটে ডাস্টবিনে ফেলে আসে।
ভদ্রলোক কথাবার্তায়ও খুব চমৎকার। রু করলেন এইভাবে, তারপর ফরিদ সাহেব, পেট কাটবার জন্যে তৈরী তো? হু, চর্বি-টবি বিশেষ নেই। আরাম করে চামড়া কাটা যাবে। সার্জন হয়ে কি মুসিবত হয়েছে জানেন? কাউকে দেখলেই কেটে ফেলতে ইচ্ছা করে। হা-হা-হা।
ডাক্তারদের নিয়ে একটা ভালো রাসিকতাও করলেন। এক রুগীর অপারেশন হবে। অপারেশন টেবিলে শোণ্ডয়ান হয়েছে। রুগী কাঁপা গলায় সার্জনকে বলল, স্যার, এটা আমার প্রথম অপারেশন। বড়ো ভয় লাগছে। সার্জন ভদ্রলোক তখন। নার্ভাস গলায় বললেন, আমারও প্রথম অপারেশন। আমারও ভয় লাগছে ভাই। রুগীকে এনেসথেশিয়া করা হচ্ছে। জ্ঞান হবার আগমুহূর্তে রুগী শুনল সার্জন সাহেব একমনে দোয়া ইউনুস পড়ছেন।
গল্প শেষ করে তিনি শব্দ করে হাসলেন। বড়ো ডাক্তাররা এত শব্দ করে হাসে না, এবং গল্পগুজবও করে না। বোধ হয় ইনি বড় ডাক্তার নন। আমি বললাম, আশা করি আমার পেট কাটার আগেও আপনি কিছু কাটাকাটি করেছেন?
ডাক্তার সাহেব আবার ঘর কাপিয়ে হাসলেন এবং তাঁর জীবনের প্রথম অপারেশনের গল্প করতে লাগলেন। বেশ জমাটি গল্প। ইনি আমার সঙ্গেই এমন গল্পগুজব করলেন, না সবার সঙ্গেই করেন? শুধু আমার সঙ্গে করে থাকলে তার অর্থ অন্যরকম হয়। খুব একটা ভালো অর্থ তা নয়।
মনসুর উঠে দাঁড়াল। সহজ স্বরে বলল, অফিসের সময় হয়ে গেল, যাই। বিকেলে আসব।
চল, এগিয়ে দিয়ে আসি।
এগিয়ে দিতে হবে না। শুয়ে থাক। ঘুম দে।
সোমবার থেকে শুয়েই থাকব, এখন একটু হাঁটাহাঁটি করি।
আমি মনসুরকে রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। চেনা পানের দোকান থেকে দশটা ফাইভ ফাইভ কিনলাম। মনসুর দেখল। কিছুই বলল না। ভালো লক্ষণ নয়। তার নিষেধ করা উচিত ছিল।
বিকেলে ঘরে থাকিস, আমি আসব।
কাজ থাকলে আসার দরকার নেই।
না, কাজ কিছু না। আর শোন, রাতে আমার এখানে খাবি। আমি বৌকে বলে এসেছি।
ঠিক আছে। সিগারেট খাবি নাকি একটা?
মনসুর একটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্তিত মুখে টানতে লাগল।
আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। মানুষের উপর আমার মায়া পড়ে না। কিন্তু জড় বস্তুর উপর সহজেই মায়া পড়ে যায়। আমার সব সময় মনে হয় জড় বস্তুরও একটা আলাদা জীবন আছে। এবং তারাও যেন মানুষের মতোই ভালোবাসতে পারে।
ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষায় এলাউ হবার জন্যে ছোটমামা আমাকে একটা রাইটার কলম কিনে দিয়েছিলেন। রোজ এটাকে বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমাতাম। এবং ঘুমাবার আগে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলতাম। যেমন, কি ভাই ঘুম পেয়েছে? আচ্ছা ঠিক আছে, ঘুমাও। ব্যাপারটা অকারণে প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং বাবা আমাকে প্রচণ্ড চড় দিয়ে মেঝেতে উন্টে ফেলে দেন। সেই সঙ্গে হুঙ্কার দিতে থাকেন, মানুষের সাথে কথা নাই, কলমের সঙ্গে কথা। পাগলছাগলের ঝাড়। পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলব আর যদি কোন দিন শুনি।