আমি কি ভয় পাচ্ছি
মনে হয় পাচ্ছি। সারাক্ষণ কেমন এক নতুন ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করেছি। যেন সব কিছুই আছে, তবুও কিছুই নেই। স্বপ্ন দেখার মতো ব্যাপার। সব কিছুই ঘটছে। অথচ কিছুই ঘটছে না। মনের ভেতর কোথায় যেন চাপা একটা উত্তেজনাও অনুভব করছি। সেই উত্তেজনাটি কী কারণে, তাও স্পষ্ট নয়।
গত রাতে অনেকক্ষণ জেগে থেকে ঘুমাতে গেলাম। ঘুমাবার আগে-আগে মুখে বসন্তের দাগওয়ালা এক জন নার্স এসে বলল, আপনি কি ওষুধ খেয়েছেন? কোন ওষুধের কথা বলছে বুঝতে পারলাম না। তবু হাসিমুখে বললাম, হ্যাঁ। সে বলল, ঘুমিয়ে পড়ুন। জেগে আছেন কেন? মেয়েটির চেহারা ভালো নয়, কিন্তু এমন মিষ্টি গলার স্বরা বারবার শুনতে ইচ্ছা করে।
ঘুম আসতে অনেক দেরি হল। এবং আশ্চর্য চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখলাম। কে যেন বলেছিল, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমুলে কেউ স্বপ্ন দেখে না। কথাটা সত্যি নয়।
আমি দেখলাম, জেসমিনহাসপাতালে আমাকে দেখতে এসেছে। পিকনিকে যে শাড়ি পরে গিয়েছিল সেই শাড়ি তার গায়ে। গলায় চিকন একটি চেইন। চুল বেণীবাঁধা। আমার স্বপ্ন হল বাস্তবের চেয়ে স্পষ্ট। ঘুমের মধ্যেই আমি তার গায়ের ঘাণ পেলাম। জেসমিন বলল, আপনাকে দেখতে এলাম। অবেলায় ঘুমাচ্ছেন কেন, উইন তো! আমি উঠে বসলাম, সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটা অন্য রকম হয়ে গেল। দেখলাম হাসপাতাল নয়, আমি আছি আমার মেসে। জেসমিন চুল আচড়াচ্ছে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে, তার চুল এখন আর বেণী করা নয়। খুলে দেওয়া। সে-চুল হাওয়ায় উড়ছে।
স্বপ্নে সব কিছুই খুব স্বাভাবিক মনে হয়। হাসপাতাল থেকে মেসে চলে আসার দৃশ্যটিও আমার কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হল। এক বার অবশ্যি অস্পষ্টভাবে মনে হল এটা সত্যি নয়। এটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন। হয়তো এক্ষুণি আমার ঘুম ভেঙে যাবে। জেসমিন চুল বাঁধতে-বাঁধতে বলল, ইশ, আপার শাড়িটা ছিঁড়ে ফেলেছি। আপা যা রাগ করবে। বলতে বলতে সে হাসল। আমিও হাসতে শুরু করলাম। শাড়ি ছেড়ার প্রসঙ্গে দুজনের হাসার ব্যাপারটি মোটও অস্বাভাবিক বলে মনে হল না। যেন এটাই স্বাভাবিক। স্বল্প কত অর্থহীনই না হতে পারে।
জেগে উঠে দেখি বালিশ ভিজে গেছে। অর্থহীন হাসাহাসির একটি স্বপ্ন দেখেও খুব কেঁদেছি।
জেসমিন, জেসমিন, তোমার সঙ্গে এ জীবনে বোধহয় আর দেখা হবে না। এ জীবনের পরেও কি অন্য কোনো জীবন আছে? অনন্ত নক্ষত্ৰবীথির কোথাও কি আবার দেখব তোমাকে?
বকুল ফুলের গন্ধ
মাথার উপর উজ্জ্বল আলো। চারদিকে মুখোশ-পরা সব মানুষ। সাবাই বড় বেশি চুপচাপ। আমার একটু শীতশীত করছে। কে এক জন আমার নাকের উপর কী একটা চেপে ধরে বললেন, সহজভাবে নিঃশ্বাস নিন। বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি। নেত্রকোণায় আমাদের বাড়ির পাশে বকুলগাছে প্রচুর ফুল ফুটত, সেই বকুলগাছে এক বার কে চাকু দিয়ে কেটে লিখুল ফরিদনীলু। নীলু ফুড কন্ট্রোলার সাহেবের বড় মেয়ে। বাবা সেই লেখা পড়ে আমাকে উঠোনে চিৎ করে ফেলে পেটে পা দিয়ে চেপে ধরে বললেন, বেশি রস হয়েছে? গাছে প্রেমপত্র লেখা হচ্ছে। নীলু এখন কোথায় আছে? কত বড়ো হয়েছে সে? সে কি দেখতে আগের মতোই আছে, না বদলে গেছে? সবাই আমরা বদলে যাই কেন?
আবার কে যেন বললেন, সহজভাবে নিঃশ্বাস নিন। তাঁর কথা অনেক দূর থেকে আসছে। আমি মনে মনে বললাম, আপনারা আমাকে বাঁচিয়ে তুলুন, একটি খুব জরুরী কথা আমার বলা হয় নি। অস্পষ্টভাবে কেউ যেন বলল, কী সেই কথা? কী কথা, সেটা আর মনে পড়ছে না। আমি প্রাণপণে মনে করবার চেষ্টা করলাম। বকুল ফুলের গন্ধের সঙ্গে সেই কথা মিশে গেছে। কিছুতেই আলাদা করা যাচ্ছে না। কে যেন গম্ভীর স্বরে বলল, তাড়াতাড়ি মনে করবার চেষ্টা করুন। সময় নেই। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমি খুব স্পষ্টভাবে বললাম, আমি সবাইকে ভালোবাসি। এই কথাটি কখনো কাউকে বলা হয় নি। আমাকে বলার সুযোগ দিন, আমার প্রতি দয়া করুন।
ডাক্তারের কথা শুনতে পাচ্ছি। তিনি বলছেন, আপনি বডড নড়াচড়া করছেন। সহজভাবে শ্বাস নিন।
আমি শ্বাস নিই। বকুল ফুলের গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।