আছে বোধ হয়। দেখ চৌকির নিচে।
মনসুর আমার সবুজ রঙের হ্যাণ্ডব্যাগ টেনে বের করল এবং তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার করতে বসল। কিন্তু সোমবারের এখনো অনেক দেরি, আজ মাত্র বুধবার। এবং বুধবারও শেষ হয়ে যায় নি। সবে শুরু হয়েছে। এখন বাজছে দশটা। আমি বললাম, চা খাবি?
খাব। এই হ্যাণ্ডব্যাগ নিয়ে যেতে পারব না। হ্যাণ্ডেলফ্যাণ্ডেল কিছুই নেই। আমি একটা নিয়ে আসব। থামোয়াক্কও আনব।
ঠিক আছে।
আর কী কী লাগবে বল, লিষ্টি করে ফেল।
হাসপাতালে যেতে হলে কী কী নিতে হয় কে জানো টুথপেস্ট এবং টুথব্রাশ, এই দুটি জিনিস নিশ্চয়ই লাগে। টুথপেস্ট আছে। এ মাসের দু তারিখেই কেনা হয়েছে। চিরুনি নিতে হয় নিশ্চয়ই। নাকি, চিরুনি দিয়ে কেউ মাথা আঁচড়ায় না? রুগীদের এসব করতে নেই।
হাসপাতাল সম্পর্কে আমার তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। প্রায় এক যুগ আগে বড়োআপ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেই যাওয়া ছিল উৎসবের যাওয়া। আমাদের মধ্যে দারুণ হৈ-চৈ ও উত্তেজনা। একটি প্রকাণ্ড স্যুটকেস ঠেসে বোঝাই করা হল। সেখানে সকালে পরার শাড়ি, বিকেলে পরার শাড়ি। গায়ে মাখার পাউডার, পানের মশলা, সবই আছে। বড়োপা ক্ৰমাগত কাঁদছে, আমাদের খুব ফুর্তি। সবাই হাসছি। আমি এবং আমার মেজো ভাই ছুটে গিয়ে বেবিট্যাক্সি নিয়ে এলাম। বড়োজাপা তার বিশাল পেট নিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে উঠল বেবিট্যাক্সিতে। বড়ো সুখের যাত্রা। আমার বাবা, যিনি প্রায় কোন ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করেন। না, মুখ সবসময় আমশি করে রাখেন, তাঁকেও দেখা গেল হাতে সিগারেট নিয়ে হাসিমুখে কথা বলছেন। (কথা বলছেন, মানে উপদেশ দিচ্ছেন। আমার বাবা উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন না হলে কথা বলেন না।) দুলাভাই লাজুক ভঙ্গিতে বড়োআপার পাশে গিয়ে বসলেন। আমার মা বললেন, বজলু, তুমি ব দিকে বস। মার অনেক ডান-বামের ব্যাপার ছিল। দুলাভাই বাধ্য ছেলের মতো মার কথা শুনলেন। মা বেবিট্যাক্সিতে ওঠার আগে তিন মিনিটি দাঁড়িয়ে লম্বা কী একটা দোয়া পড়লেন। খুব সম্ভব সুরা আর রহমান। এই দোয়াটি তাঁর খুব পছন্দ। খুব নাকি কড়া দেয়া। খুব কাজের।
বিভিন্ন রকম দোয়া দরুদ মার মুখস্থ। তাঁর কাছে এক কপি নেয়ামুল কোরান আছে। এই গ্রন্থটিকে তিনি যাবতীয় সমস্যার সমাধান বলে মনে করেন। এক বার তাঁর বালিশের নিচ থেকে আংটি চুরি হয়ে গেল। তাঁর মুখ হয়ে গেল মরা মানুষের মতো। দেখলাম তিনি নেয়ামুল কোরানের পাতা ওল্টাচ্ছেন। সেখানে নাকি হারান জিনিস খুঁজে পাওয়ার একটা দেয়া আছে। সারা দুপুর মা সেই দোয়া পড়লেন। মাঝারি সাইজের এক বালতি চোখের পানি ফেললেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে আংটি পাওয়া গেল। মা গম্ভীর গলায় বললেন, বিশ্বাস তো করি না, দোয়ার মরতবা দেখলি?
মার দোয়া অবশ্যি সব সময় কাজ করে না। কাজ করলে বড়োআপ হাসপাতাল থেকে ফিরত। সে ফেরে নি। বার-তের বৎসর আগের ব্যাপার। এখন আর সব কিছু পরিষ্কার মনে নেই।
কষ্টের ব্যাপারগুলি মানুষের ভালো মনে থাকে না। সে কখনো মনে রাখতে চায় না। কিন্তু সুখের ব্যাপার খুব ভালোভাবে মনে থাকে। কারণ এগুলি নিয়ে প্রায়ই ভাবা হয়। যেমন আমার মেজো ভাইয়ের জার্মানী যাওয়ার ব্যাপারটা। এক দিন সন্ধ্যাবেলা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল-সে জার্মানি যাচ্ছে।
বাবা প্রচণ্ড ধমক লাগালেন, কী বলছিস এসব? জার্মানি যাচ্ছি মানে?
বাবা বিদেশযাত্রার পক্ষপাতী নন এবং এজন্যেই ধমকাচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। তিনি না ধমকে কথা বলতে পারেন না। পরবর্তী সময়ে আমি এর কারণ বের করেছিলাম। বাবার চাকরিটা ছিল ছোট। অফিসে সবাই তাঁকে ধমকাত। বাসায় এসে তা ভুলতে চেষ্টা করতেন। এবং প্রায় প্রতিটি ব্যাপারেই চেঁচাতেন। জার্মানির ব্যাপারেও তিনি চেঁচাতে শুরু করলেন, পাখা উঠেছে? জার্মানি-আমেরিকা? টাকা দেবে কে? গাছ থেকে আসবে? বৃক্ষ থেকে আসবে?
টাকা দিতে হবে না।
যাবি কী ভাবে, সাতার দিয়ে? এ্যাঁ, সন্তরণ?
মেজো ভাই থমত খেয়ে বলল, টাকা ওরা দিচ্ছে। স্কলারশিপ। আমাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না। চিরকাল শুনে এসেছি ওর ভাই বাইরে যাচ্ছে, ওর চাচা যাচ্ছে। মামা আমেরিকা থেকে জিনসের প্যান্ট পাঠিয়েছে। খালা জাপান থেকে হাওয়াই শার্ট পাঠিয়েছে। মেজো ভাইয়ের ব্যাপারটা আমাদের কারো বিশ্বাস হল না। তবু এক দিন সে বেমানান একটা কর্ডের কোট পরে সত্যিই জার্মানি চলে গেল। এয়ারপোর্টে বাবা কেঁদেকেটে তাঁর চারপাশে ভিড় জমিয়ে ফেললেন। আরো অনেকের আত্মীয়স্বজন যাচ্ছিল। তাদের হয়তো কাঁদার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বাবার। কান্না দেখে সবার চোখে পানি এল। এক জন অপরিচিত বয়স্ক লোক বাবাকে জড়িয়ে ধরে–কাঁদবেন না ভাই, কাঁদবেন না ভাই বলে নিজেও বাবার মতো আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলেন। সেই ভদ্রলোক গাড়িতে করে আমাদের বাসায় পৌছে দিলেন। অনেক টাকা বেঁচে গেল আমাদের। এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট। বাস ভাড়াই নেয় দু টাকা। আমরা এতগুলি মানুষ।
বাবার শোকের ভঙ্গি সব সময়ই এরকম। বড়োআপার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি যে গভীর দুঃখের প্রকাশ দেখিয়েছিলেন, জগতের আর কোনো বাবা এরকম দেখিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। আমি সেদিন বাবার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলাম।
বড়োনার প্রতি বাবার একটি আলাদা পক্ষপাতিত্ব ছিল। তাকে তিনি কখনো ধমক দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। খুব ছোটবেলায় এক বার নাকি একটা চড় দিয়েছিলেন। এতেই বড়োপাকাঁদতে-কাঁদতে বিছানা নেন এবং তাঁর টাইফয়েড হয়ে যায়। জীবনসংশয় যাকে বলে। ব্যাপারটা হাস্যকর। টাইফয়েড একটা জীবাণুঘটিত ব্যাপার। চড় দিয়ে কারো টাইফয়েড বাধিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু বাবাকে এসব কে বোঝাবে? টাইফয়েডের এই গল্পটি তিনি কয়েক লক্ষ বার করেছেন এবং অনেককেই অস্বস্তিতে ফেলেছেন।