এত সকালে বাড়ি গিয়ে করব কী?
বৌয়ের সঙ্গে গল্প করবি।
দেখি, যাব। আরেকটু বসি। এমন করছিস কেন?
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে, এখন যা।
মনসুর তবু বসেই রইল। সম্ভবত তার যেতে ইচ্ছে করছে না। তার স্বভাবই এরকম, কোথাও গেলে কিছুতেই উঠতে চাইবে না। বিয়ের পরও সে-স্বভাবের তেমন পরিবর্তন হয় নি।
ফরিদ, উঠি? কাল রীনাকে নিয়ে আসব।
আসতে হবে না।
হবে না কেন?
আজই আসতে চেয়েছিল। বৃষ্টির জন্যে আনি নি।
আমি মনসুরকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলাম। এই অল্প সময়ের মধ্যেই সে তার শ্বশুরবাড়ির প্রসঙ্গ নিয়ে এল। তার এক মামাশ্বশুর নাকি তাকে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছেন–তার ঝুীজ আছে কিনা। এই কথা কটি সে বলল নিচু গলায়। এমন কী রহস্যময় কথা যে ফিসফিস করে বলতে হবে? মনসুর বলল,
এটা কেন জিজ্ঞেস করল বুঝতে পারছিস?
না।
একটা ফ্ৰীজ কিনে দেবে আর কি!
বলিস কি।
আরে, ওদের কি আর অভাব আছে নাকি?
সুখী মানুষের মত হাসিমুখে নিচে নামতে লাগল মনসুর। তার মানে কি কোননী দুঃখ নেই? সে কি সত্যি সত্যি এক জন পরিতৃপ্ত সুখী মানুষ।
আমি মনসুরকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ঘরে এসে দেখি এক জন বুড়ো ভদ্রলোক এসেছেন আমাদের ঘরে। আমার রুমমেটের বাবা। অবিকল এক রকম চেহারা। বাবা ও ছেলের মধ্যে এমন মিল সচরাচর দেখা যায় না। তারা কথা বলছে নিচু স্বরে। আমি বুড়ো ভদ্ৰলোককে সালাম টালাম কিছু দিতাম। কিন্তু তিনি এক বারও ভালো করে তাকালেন না আমার দিকে।
আমি বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে বসে রইলাম। এক জন প্রফেসর সাহেব সম্ভবত রাউণ্ড দিতে বের হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে তিন জন ছাত্র, এক জন নার্স। প্রফেসর সাহেবকে খুব মেজাজী মনে হল–যাকে দেখছেন তাকেই ধমকাচ্ছেন। আমার সামনে এসে থমকে দাড়ালেন।
আপনি কি রুগী?
জ্বি।
বাইরে বসে আছেন কেন?
এম্নি বসে আছি।
যান, ঘরে যান।
ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। প্রফেসর সাহেব বুড়ো ভদ্রলোকের দিকে আগুন চোখে তাকালেন, কিন্তু কিছু বললেন না। বুড়ো ভদ্রলোক নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন, আপনার অপেনিংয়ের ডেট দিয়েছে? আমি তাঁর কথা বুঝতে পারলাম না।
অপারেশনের ডেট হয়েছে কি?
জ্বি-না।
প্রিলিমিনারি টেস্ট?
এখনো কিছু হয় নি।
সে কি।
আমি মাত্র গতকাল এসেছি।
তাতে কি? চৰ্বিশ ঘন্টা তো পার হল। এই যে ইয়ং ডক্টরস, তোমরা করছ। কি?
ইন্টার্নি ডাক্তাররা নার্ভাস ভঙ্গিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। ডাক্তার সাহেব এগিয়ে এলেন আমার রুমমেটের দিকে।
জুবায়ের সাহেব আছেন কেমন?
ভালো।
কী পড়ছেন?
থ্রিলার।
ইন্টারেস্টিং নাকি?
আছে মোটামুটি।
আপনার অপারেশন শিডিউল হয়েছে তো?
জ্বি, কাল।
কি, নার্ভাস?
নাহ।
দ্যাটস গুড। কখন টাইম দিয়েছে?
সকাল এগারটা।
আজ বেশি রাত জাগবেন না। শুয়ে পড়বেন।
জুবায়ের সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না।
টেনশন কমাবার জন্য দুটি ট্যাবলেট দিচ্ছি, খেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুবেন।
ঠিক আছে।
জুবায়ের সাহেব ঘুমুতে গেলেন না। রাত এগারটা পর্যন্ত নিঃশব্দে থ্রিলার পড়তে লাগলেন। আমি এক বার জিজ্ঞেস করলাম–সিগারেট খেতে চান কিনা। নতুন এক প্যাকেট দামী সিগারেট দিয়ে গেছে রহমান, দিনে চারটার বেশি খাব না–এই চুক্তিতে। জুবায়ের সাহেব সিগারেটের আমন্ত্রণে সাড়া দিলেন না!
আমি চাদর টেনে ঘুমুতে গেলাম। তখন তিনি ডাকলেন।
ফরিদ সাহেব।
বলুন। লক্ষ করেছেন, এ্যানি আজ আসে নি?
জ্বি, লক্ষ করেছি।
আপনার কথাও ঠিক হতে পারে।
কিসের কথা বলছেন?
ঐ যে বলেছিলেন এ্যানি রাগ করেছে, কিন্তু জানতে দেয় নি।
আমি কোনো কথা বললাম না।
কাল আমার অপারেশন, আজ তার আসা উচিত ছিল।
ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল, আসতে পারেন নি।
ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তো অনেকেই এসেছে। তাছাড়া সে আসবে গাড়িতে। ঝড়বৃষ্টিতে তার কী অসুবিধা
হয়তো মন খারাপ হবে বলে আসেন নি। কিংবা হয়ত শরীর খারাপ।
দিন একটা সিগারেট। মন খারাপের কথা যেটা বললেন, সেটাই বোধ হয়। ঠিক। ওকে আপনার কেমন লাগল?
ভালো।
শুধু ভালো? বেশ ভালো।
ও একটি একসেপশনাল মেয়ে। দূর থেকে এতটা বোঝা যায় না। ভালো করে না মিশলে আপনি বুঝবেন না।
আমি চুপ করে রইলাম। জুবায়ের সাহেব গাঢ় স্বরে বললেন, এ্যানির সঙ্গে পরিচয় হওয়াই ভাগ্যের ব্যাপার। পরিচয়টা স্থায়ী হল না।
এখনই এত নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?
তিনি থেমে থেমে বললেন, আমি নিজেও এক জন ডাক্তার। দিন, আরেকটা সিগারেট দিন। আমি প্যাকেট বাড়িয়ে দিলাম।
ফরিদ সাহেব।
জ্বি।
আপনি কি বিয়ে করেছেন?
না।
বিয়ে করেন নি কেন?
বিয়ে করার মতো সামর্থ্য কখনো হয় নি।
শুধু এই জন্যেই বিয়ে করলেন না?
হ্যাঁ, এই জন্যেই।
কোনো মেয়ের সঙ্গে কি কখনো পরিচয় হয়েছে?
আপনি যে অর্থে বলছেন, সেই অর্থে হয় নি।
ভালো লাগে নি কাউকে?
লেগেছে।
তাদের কাউকে কি তা বলেছেন?
না, বলা হয় নি।
ফরিদ সাহেব।
জ্বি।
বলেন নি কেন?
সাহস হয় নি।
বলা উচিত ছিল। এ্যানিকে কিছু বলার সাহস আমারও ছিল না। আমি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। আর দেখেছেন তো আমাকে, বাশগাছের মত ল। মেডিকেল কলেজে আমার নাম ছিল, বেঙ্গল বেধ্যে, বাংলাদেশের বাশ। তবু আমি সাহস করে বলেছিলাম।
এ্যানিও কি ডাক্তার?
হ্যাঁ, সেও ডাক্তার। আমরা একই ইয়ারেই পাশ করি।
জুবায়ের সাহেব, ঘুমিয়ে পড়েন।
আজ রাতটা আমি জেগে থাকতে চাই। আজ সারা দিন কী ভেবে রেখেছিলাম জানেন?
কী?
এ্যানিকে বলবরাতটা এখানে থেকে যেতে। গল্প করে কাটিয়ে দেওয়া যেত। আপনিও গল্প করতেন আমাদের সঙ্গে। অসুবিধা কিছু ছিল না। কি বলেন?