ভদ্রলোকের সঙ্গে সারা দিন আমার আর একটি কথাও হল না। যেন তিনি আমাকে চেনেন না। একটি বই মুখের সামনে ধরে শুয়ে রইলেন। আমি এক বার জিজ্ঞেস করলাম, কী পড়ছেন?
থ্রিলার।
বলেই এমনভাবে তাকালেন, যার অর্থ হচ্ছে আমাকে বিরক্ত করবেন না।
দুপুরের পর থেকে চার দিক অন্ধকার করে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। বেশ ভালো ঝড়। আজ কোন ভিজিটার আসবে না। এমন দিনে ঘর থেকে কেউ বেরুবে না।
আজ অবশ্য কারো আসার কথা নয়। তবু কেউ কেউ হয়তো আসতে চাইবে। পিছিয়ে যাবে ঝড় দেখে। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমাকে দেখতে আসার কেউ নেই।
আশ্চর্য, যার কথা কখনো ভাবি নি সেই দুলাভাই এসে পড়লেন। দুলাভাই বলাটা ঠিক হচ্ছে কিনা কে জানে। বড়োআপা মারা গেছেন সেই কবে। এর মধ্যে তিনি বিয়ে-টিয়ে করে ঘর-সংসার শুরু করেছেন। পুরনো আত্মীয়তা বা সম্পর্কের কিছুই তো এখন নেই।
ফরিদ, কেমন আছ?
ভালো আছি।
দুলাভাই বেশ কিছু কলা নিয়ে এসেছেন। সেগুলি থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। তাঁর গা বেয়েও পানি ঝরছে।
গামছা দিয়ে গা মুছে ফেলুন। অসুখ করবে।
না, কি অসুখ করবে?
তিনি সাবধানে কলাগুলি বেডের নিচে রাখলেন, মুখে কিছু বললেন না। তাঁর স্বভাব বেশি বদলায় নি। তাকে আগের মতোই ভাবুক মনে হল।
খবর পেয়েছেন কার কাছে দুলাভাই?
তোমার বন্ধু মনসুরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
ও।
অপারেশনের ডেট দিয়েছে?
জ্বি-না। টাকাপয়সা লাগবে ফরিদ?
জ্বি-না। লাগবে না। আপনি চলে যান দুলাভাই, ঠাণ্ডা লাগবে।
এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে যাব কোথায়? বসি খানিকক্ষণ।
ফ্লাস্কে চা আছে, খাবেন?
না, চা খাই না। গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম আছে।
দুলাভাই খুব সাবধানে শার্টের ভেতরের পকেট থেকে একটা মুখবন্ধ খাম বের করে আমার বালিশের নিচে রেখে দিলেন।
কী রাখলেন?
তেমন কিছু না।
এটা দুলাভাইয়ের আজ নতুন কিছু না। আগেও অনেক বার এ রকম হয়েছে। হঠাৎ একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে হয়তো আমার মেসে এসেছেন। চুপচাপ বসে থেকেছেন কিছুক্ষণ। যাবার সময় লজ্জিত ভঙ্গিতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট রেখে। দিয়েছেন টেবিলের উপর।
টাকা লাগবে না। টাকা কি জন্যে?
চাটা খাও বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে বেশি কিছু তো না। সেই সামর্থ্যও নেই।
তিনি এসব কি তার মৃতা স্ত্রীর স্মরণে করেন? কি জানি। মানুষের কত রকম বিচিত্র স্বভাব থাকে। সব মানুষই অবশ্যি বিচিত্র। এক জনের সঙ্গে অন্য জনের কিছুমাত্ৰ মিল নেই। সে জন্যেই কি এক জনের মধ্যে অন্য জনের ছায়া দেখলে আমরা এমন চমকে উঠি? অসংখ্য বার বলি–আজ নিউমার্কেটে একটা ছেলের সঙ্গে দেখা, অবিকল সালামের মতো, ঠিক সেই রকম হাটার ভঙ্গি।
দুলাভাই খোলা জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে আছেন। কবি-সাহিত্যিক বোধ হয় এভাবে তাকায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে তাদের চোখের দৃষ্টি কোমল হয়ে ওঠে। দুলাভাইয়ের যেমন হয়েছে। আমি বললাম, দুলাভাই, আপনার বাচ্চারা ভালো?
হুঁ।
এই প্রশ্নটি কি আমি তাঁকে দ্বিতীয় বার করলাম? আমার মনে হতে লাগল একটু আগে এই প্রশ্নটি করা হয়েছে। যখন কথা বলার কিছু থাকে না, তখনই আমরা ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন করি।
দুলাভাই, আপনি কিছু মনে না করলে একটা সিগারেট খাই।
আরে ছিঃ ছিঃ, খাও। এই বয়সে মুরুৰি দেখলে চলে? খাও। কোনো অসুবিধা নেই।
সিগারেট ধরাতে আমার সংকোচ হতে লাগল। মনে হতে লাগল কাজটা অন্যায়। সাধাসিধা ধরনের যে-মানুষটি আমার সামনে বসে আছে, তাকে আরো খানিকটা সন্মান আমার করা উচিত।
আশ্চর্য, এই দীর্ঘদিনে এক বারও কেন তাঁর খোঁজখবর করি নি? কেন এক দিনও তাঁর বাসায় উপস্থিত হয়ে বলি নি–আপনাকে দেখতে এলাম দুলাভাই, ভালো আছেন তো?
কেমন করে দুলাভাই তাঁর নতুন সংসার সাজিয়েছেন? হঠাৎ বড দেখতে ইচ্ছে করল। দুলাভাই বললেন, যাই, কেমন? বৃষ্টি কমেছে।
আমি মৃদু স্বরে বললাম, যদি অসুখ সারে, তাহলে প্রথমেই যাব আপনার বাসায়। দুলাভাই হাসলেন। হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। বিশ্বাস নাকরারই কথা। কেউ কথা রাখে না। আমিও নিশ্চয়ই রাখব না। তবু তাঁর তাতে মন খারাপ হবে না। আবারো কোনো একদিন আমাকে দেখতে আসবেন। সংকুচিত ভাবে একটা ময়লা পঞ্চাশ টাকার নোট আমার বালিশের নিচে রেখে দেবেন।
দুলাভাই চলে যাবার পর দীর্ঘ সময় আমার মন খারাপ থাকল। কেন বলতে পারি না। অত্যন্ত সাধারণ কিছু মানুষ আছে,যারা অন্যদের উপর অসাধারণ প্রভাব ফেলে। খুবই ক্ষণস্থায়ী প্রভাব, তবু তার ক্ষমতা অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই। মনসুর এসে উপস্থিত হল সন্ধ্যাবেলা। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হবার মিনিট পাঁচেক বাকি। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আসবার দরকারটা কী ছিল?
আসতাম না। রীনা বলল–ঠাণ্ডার মধ্যে চাটা খেতে ইচ্ছা হবে। ফ্লাস্কটা দিয়ে এস। চা দিয়েছে ফ্লাস্কে করে।
ফ্লাস্ক তো আমার এখানে একটা আছে। রহমান দিয়ে গেল না?
সারছে। আমি আবার একটা কিনলাম।
মনসুর চা ঢালল। পাশের ভদ্রলোককে চা সাধল। তিনি শীতল কণ্ঠে বললেন, চা খাব না।
দোকানের চা না, ঘরের চা। খান এক কাপ, ঠাণ্ডার মধ্যে ভালো লাগবে। তেজপাতা দেওয়া আছে।
থ্যাংক য়ু, আমি চা খাব না।
কী অসুখ আপনার?
অসুখ নিয়ে আমি কারো সঙ্গে ডিসকাস করি না। কিছু মনে করবেন না।
না-না, ঠিক আছে।
মনসুর থাকল সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। সে কথা না বলে এক সেকেণ্ডও থাকতে পারে না। সাতটা পর্যন্ত সে ক্রমাগত কথা বলে বলে আমার মাথা ধরিয়ে দিল। আমি বললাম, এখন বাড়ি যা মনসুর।