ওর চোখ ভেজা। কাঁদছিল হয়তে।
অনেক দিন ধরে সে আর কথা বলে না, শুধু শোনে। কথা বলি আমি একা। আচ্ছা, আজ চলি।
ওনার কী হয়েছে?
কী হয়েছে শুনে কী করবেন? ও মারা যাচ্ছে।
ভদ্রলোক রাত একটা পর্যন্ত বই পড়লেন। আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। কেন জানি খুব ক্লান্ত লাগছে। এই অপরিচিত জায়গায় আমার ঘুম আসার কথা নয়, তবু আজ বোধহয় ঘুম আসবে। ভদ্রলোক বাতি নিভিয়ে নরম স্বরে ডাকলেন, ফরিদ সাহেব।
বলুন।
ঘুমান নি?
জ্বি না। নতুন জায়গায় ঘুম আসে না।
আমারো আসে না। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন, হাসপাতালের প্রথম রাতে আমি মড়ার মতো ঘুমিয়েছিলাম। ওষুধপত্র ছাড়াই দীর্ঘ ঘুম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
ফরিদ সাহেব, আপনার কি ঘুম পাচ্ছে?
জ্বি।
ঘুমাবেন না। কষ্ট করে হলেও জেগে থাকেন। হাসপাতালের অনেক রকম কুসংস্কার আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, যে হাসপাতালের প্রথম রাতে আরাম করে ঘুমায়, সে আর হাসপাতাল ছেড়ে জীবিত অবস্থায় বের হয় না।
তাই নাকি?
এই কুসংস্কারটা আগে জানতাম না। জানলে আমি জেগে থাকতাম।
ভদ্রলোক অন্ধকারের মধ্যেই হাসলেন। যিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে কোনো কথা বলেন নি, তিনি আমার সঙ্গে এত কথা বলছেন কি জন্য?
ফরিদ সাহেব।
জ্বি?
আপনার সঙ্গে সিগারেট আছে?
জ্বি, আছে।
দিন একটা। আমার খাওয়া নিষেধ, কিন্তু এখন খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। আপনার কি ঘুম পাচ্ছে নাকি?
মনে হয় পাচ্ছে।
ঘুমাবেন না, উঠে বসুন। ভুল করবেন না।
কুসংস্কারটাকে আপনি এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?
ভদ্রলোক জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলেন। সিগারেটের আলো এক-এক বার উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। তাঁর ফর্সা মুখ দেখা যাচ্ছিল। এত ফর্সাও মানুষ হয়।
ফরিদ সাহেব।
বলুন।
এ্যানির সঙ্গে আমার ক দিন হয় বিয়ে হয়েছে বলুন তো?
বলতে পারব না।
অনুমান করুন।
দু বছর?
না। তিন মাস। আমি নিজে তখন আমার অসুখের কথাটা জানি। কিন্তু সেটা গোপন করেই ওকে বিয়ে করেছিলাম। কিছু কিছু মেয়ে থাকে ফরিদ সাহেব যাদের জন্যে যে কোন ধরনের অন্যায় করা যায়।
তা ঠিক।
আমি অবশ্যি বিয়ের পরই এ্যানিকে সব খুলে বলি। আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন, সে রাগ করে নি।
হয়তো রাগ করেছে, আপনাকে বুঝতে দেয় নি।
ভদ্রলোক জবাব দিলেন না, দীর্ঘ সময় চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, দেখি, আরেকটা সিগারেট দিন।
আর খাবেন না।
এখন সিগারেট খাওয়া না-খাওয়া আমার কাছে সমান। আমি আরেকটি সিগারেট বাড়িয়ে দিলাম।
ফরিদ সাহেব।
বলুন।
ঘুম আসছে?
হ্যাঁ।
ঘুমাবেন না। কুসংস্কার হোক, যাই হোক–ঘুমাবেন না।
ঠিক আছে, ঘুমাব না।
আপনি যে বললেন সে রাগ করেছে, এটা ঠিক না। রাগ করলে ঠিকই বুঝতে পারতাম। অসুস্থ অবস্থায় মানুষের সেনসিটিভিটি বেড়ে যায়। সে হোট-ঘোট ব্যাপারগুলিও ধরতে পারে।
তাহলে হয়তো রাগ করেন নি।
না, করে নি।
ভদ্রলোকবিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গেলেন। ফিরে এলেন অনেকক্ষণ পরে। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার নয়। বারান্দায় বাতি জ্বলছে, তার আলোয় ঘরের ভেতরটাও আলোকিত। আবছা করে হলেও সব কিছু চোখে পড়ে। আমি বললাম, আপনি জেগে। আছেন কেন, আপনি শুয়ে পড়ুন।
হ্যাঁ, শুয়ে পড়ব। ঘুম আসছে। তবে একটা কথা শোনেন-জীবনের উপর আমার একটা রাইট আছে। আছে কিনা?
হ্যাঁ, আছে।
যাকে ভালোবাসি, তাকে যদি এক দিনের জন্যেও পেতে চাই, তাহেল সেটা কি খুব অন্যায়?
না, অন্যায় নয়।
আপনি আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে এটা বলছেন। কিন্তু আপনি মনে মনে এটাকে অন্যায় ভাবছেন।
না, তা ভাবছি না।
আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করবেন না। আমি কারো সান্ত্বনা চাই না। এসবের আমার দরকার নেই।
আমি চুপ করে গেলাম। ভদ্রলোক শুয়ে পড়লেন। এবং বোধহয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লেন। আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
হাসপাতালের নিজস্ব কিছু ব্যাপার আছে। সে কখনো ঘুমায় না। দিন-রাত্রি চৰিশ ঘন্টাই জেগে থাকে। এখন রাত বাজে প্রায় সাড়ে তিনটা, বারান্দায় কাদের কথা শোনা যাচ্ছে। হাসির শব্দও শুনলাম। রুগীদের সঙ্গে তাদের আত্মীয়স্বজনেরা কেউ কেউ থাকে। দারুণ অস্বস্তি নিয়ে এরা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে।
রুগীদের কেউ কেউ কাদে। ব্যাথায় কাঁদে কিংবাভয়ে কাঁদে। আয়ারা খাবারের ভাগ নিয়ে দুপুররাত্রে ঝগড়া করতে বসে।
কমবয়সী ইন্টার্নি ডাক্তাররা নিজেদের মধ্যে রসিকতা করতে করতে বারান্দা দিয়ে হাঁটেন।
কোনো একটি সময়ে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয়। রেসিডেন্ট সার্জেন্ট আসেন। নার্সরা ছোটাছুটি করতে থাকে। অপারেশন টেবিলে রুগীকে নিয়ে যাবার জন্যে ঘুমঘুম চোখে চোর হাতে আসে এটেনডেন্টরা। এনেসথেশিয়া যিনি করবেন, তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
রেসিডেন্ট সার্জেন্ট ধৈর্য হারিয়ে চেষ্টাতে থাকেন।
ঘুম চটে গিয়েছিল। শুয়ে শুয়ে কত রকম শব্দ শুনলাম। সব অচেনা শব্দ। এই বিচিত্র শব্দের সঙ্গে পরিচিত হতে কত দিন লাগবে কে জানে।
হাসপাতালের খাবারদাবার খুব খারাপ হয় বলে জানতাম। সকালের নাস্তা আমার ভালোই লাগল। এক পিস মাখন-লাগান রুটি, একটি সেদ্ধ ডিম, একটা কলা।
পাশের বেডের ভদ্ৰলোক ঘুমাচ্ছেন। তাঁর নাশতা ঢাকা পড়ে রইল। তিনি ঘুম থেকে উঠলেন নটার দিকে এবং তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্ৰকাণ্ড একটি টিফিন কেরিয়ারে করে তাঁর জন্যে খাবার এল।
ফরিদ সাহেব।
জ্বি।
আপনি কি নাশতা করে ফেলেছেন?
হ্যাঁ।
এর পর থেকে করবেন না। এ্যানি সব সময় দুজনের জন্যে খাবার পাঠায়। আজ যখন সে আসবে, আপনি তাকে বলে দেবেন কী কী জিনিস আপনার পছন্দ।