সোমবার বিকাল চারটায় রহমানের যোগাড়-করা জীপে চড়ে চলে এলাম হাসপাতালে। এই জীবন দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। এখন যেমন খারাপ লাগছে, এক সময় তেমন খারাপ লাগবে না। ফিনাইলের গন্ধও আপন মনে হবে। ডাক্তারদের সঙ্গে পরিচয় হবে। নার্সদের কেউ কেউ হাসপাতালের গল্প শুনিয়ে যাবে। যে-সুইপার বাথরুম পরিষ্কার করতে আসবে, তাকে হয়তো আমি নাম ধরে ডাকব।
মনসুর খুব উৎসাহ প্রকাশ করতে লাগল, ভালোঁ ঘর, কেমন হাওয়া দেখছি নাকি? ফাসক্লাস।
ঘরটি ভালোই। পেছনে এক চিলতে বারান্দা। দাঁড়ালে শিশুপার্ক দেখা যায়। সেদিকটা বড়ো সবুজ। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে ধাঁধা লাগে।
এই ফরিদ, এটা ইংলিশ বাথরুম।
বাথরুম খুলেই মনসুর মহা উল্লসিত। ভাবখানা এরকম, যেন ইংলিশ বাথরুম ছাড়া আমি বাথরুম করতে পারি না।
ফরিদ, ময়লা আছে, সুইপার দিয়ে ক্লীন করিয়ে দেব। পাঁচটা টাকা খাওয়াতে হবে। ফ্লাস্ক খোল, চা খাওয়া যাক।
রহমান বলল, আমি খাব না। আমার বমি বমি আসছে, হাসপাতালের গন্ধ আমার সহ্য হয় না। মনসুর দাঁত বের করে হাসল, হাসপাতালে ফুলের গন্ধ থাকবে নাকি রে শালা? হাসপাতালে থাকবে ওষুধের গন্ধ, রোগের গন্ধ। যেখানকার যা নিয়ম। এর মধ্যেই মনসুর আবিষ্কার করল ফ্যানের রেগুলেটারটা খারাপ, ধরলেই শক দেয়। বাথরুমের ফ্লাশ কাজ করে না। দরজার ছিটকিনি কাজ করে না। সে নোটবই বের করে লিখে ফেলল। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই নাকি সেসব ঠিক করে ফেলবে। টাকা খাওয়াতে হবে। টাকা খাওয়ালেই সব ঠিক। টাকাটা সে কাকে খাওয়াবে, কে জানে? আমি বললাম, আরেক জন রুগী থাকার কথা না?
রুগীর বিছানা-বালিশ সবই আছে, রুগী নেই। মনসুর গম্ভীর হয়ে বলল, রুমমেট যাকে পেয়েছিস–মালদার পার্টি। জিনিসপত্র দেখ না। থার্মোফ্লাস্কটা দেখেছি? মিনিমাম এক হাজার টাকা দাম।
রহমান সত্যি সত্যি অস্বস্তি বোধ করছে। দু বার বলল, ফিনাইলের গন্ধে তার মাথা ধরে যাচ্ছে। কিন্তু মনসুরের ওঠার কোনো তাড়া দেখা গেল না। সে রুগী। সম্পর্কে খোঁজ নিতে গেল। সেইসঙ্গে এক জন আয়া নিয়ে আসবে, যে নাকি সব দেখেশুনে রাখবে। এটা-সেটা এনে দেবে। অসুবিধা হলে রাত-বিরেতে ডাক্তারকে খবর দেবে। মনসুর বিজ্ঞের মতো বলল, হাসপাতাল কি ডাক্তাররা চালায়। হাসপাতাল চালায় আয়ারা। এক জন ভালো আয়া পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। রহমান বিরক্ত হয়ে বলল, ছেলেদের ওয়ার্ডে আয়া আসতে দেবে নাকি? কী যে সব কথাবার্তা
আয়া নয়, এক জন বেঁটে ছোকরাকে সে ধরে নিয়ে এল, খুব নাকি ওস্তাদ। ছোকরার নাম মজু মিয়া।
নতুন জীবন শুরু হল।
আমার পাশের বেডের রুগীর নাম জুবায়ের। আনকমন নাম। ভদ্রলোকও বেশ আনকমন। দারুণ ফর্সা এবং দারুণ রোগা। লম্বাও প্রায় ছ ফুটের মত। যখন শুয়ে থাকেন, তখন কেন জানি সাপের মতো লাগে। সাপের উপমাটি ঠিক হল না। সাপের মধ্যে একটা ঘিনঘিনে ব্যাপার আছে, একটা গতি আছে। এর মধ্যে তা নেই। এর চারদিকে একটা আলস্যের ভাব আছে। রোগের জন্যই হয়তো। বয়সও ধরা যাচ্ছে না, পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে হবে। রোগা মানুষের বয়স ধরা যায় না। ভদ্রলোক কথা বলেন খুবই কম। আমি যখন বললাম, আমি আজ বিকেলে এসেছি। আপনি অন্য কোথাও ছিলেন, আপনার সঙ্গে সে জন্যই দেখা হয় নি। আমার নাম ফরিদ। তিনি শুধু বললেন, আমার নাম জুবায়ের। আর কোনো কথা হল না।
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হবার পর ভদ্রলোকের স্ত্রী এলেন। তিনি আমার সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দিলেন, এ এ্যানি, আমার স্ত্রী।
এ্যানি নামের মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন। নরম স্বরে বললেন, আপনাকে কিন্তু ও খুব জ্বালাবে। রাত জেগে বই পড়বে। আগে যে-রুগী ছিল সে রোজ কমপ্লেইন করত।
আমি করব না। কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
কেন, আপনি কি সন্ন্যাসী?
মেয়েটির মুখ হাসি-হাসি, তাকিয়ে আছে আমার দিকে। উত্তর জানতে চায় হয়তো।
কি, বলুন। আপনি কি সংসারবৈরাগী?
জ্বি-না।
সন্ন্যাসী হওয়া ঠিক না। রাগ, ঘৃণা, অভিমান, অভিযোগ–এসব থাকা উচিত। এসবের দরকার আছে।
মেয়েরা এত গুছিয়ে কথা বলতে পারে, তা জানা ছিল না। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ভদ্রমহিলার বয়স তেইশ-চরিশের বেশি হবে না। কালো রঙ। মাথাভর্তি চুল, বেণী করা নেই। পিঠময় ছড়িয়ে দেওয়া। এর দিকে তাকিয়ে বলে দেওয়া যায়–অনেক ছেলেরা এই মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। মেয়েটি এদের সবাইকে ছেড়ে ফর্সা ও রোগা পোকটির কাছে এসেছে। কেন এসেছে? কী আছে লোকটির মধ্যে?
এ্যানির অন্য সব প্রেমিকদের আমার দেখতে ইচ্ছা করল। মেয়েটি বসেছে বিছানার পাশে, কথা বলছে মৃদু স্বরে। কিন্তু কথা বলছে সে একাই। লোকটি শুধু শুনে যাচ্ছে। এমন কি হা-হু পর্যন্ত বলছে না। শুয়ে শুয়ে ওদের কথা শোনা ঠিক হচ্ছে না। আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশ বড়ো বারান্দা। রুগী দেখতে-আসা লোকজনরা হাঁটাহাটি করছে। একটা লাল সোয়েটার পরা বাচ্চা টুকটুক করে দৌড়াচ্ছে। এই গরমে তাকে সোয়টার পরিয়েছে কেন, কে জানে। আমি ডাকলাম, এই খোকা। এ্যাই। ছেলেটি অবাক হয়ে আমাকে দেখল, তারপর খেলতে লাগল। নিজের মনে। শিশুদের মন পাওয়া খুব কঠিন। এ্যানি বেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এল।
ফরিদ সাহেব, যান ভেতরে যান। আমরা এমন কিছু বলি না যে, অন্য কেউ শুনতে পারবে না। আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে বাইরে এলেন।