গল্প কর।
তুমি একটা গল্প বল। আমি শুনি।
আলতাফ বলল, আমি তো গল্প জানি না।
সত্যি জান না?
না।
তাহলে কথা বল। যা ইচ্ছা বল। তোমার কথা শুনতে ভাল লাগে।
আলতাফ পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, আমার কথা বলতে ভাল লাগে না। তুমি বল আমি শুনি।
দূলারী আলতাফের গায়ে হাত রাখতে রাখতে বলল, আমাকে বিয়ে করে তুমি কি খুশি হয়েছ?
খুশি-অখুশির কি আছে?
তুমি আমাকে ভালবাস না?
আলতাফ ক্লান্ত গলায় বলল, ভালবাসাবাসির এখানে কি আছে? পোকারা ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলে তুমি আমাকে বিয়ে করেছ।
পোকারা ব্যবস্থা করে দিয়েছে?
হ্যাঁ। ওরা তোমার মাথাটা গণ্ডগোল করে রেখেছে বলেই তুমি সারাক্ষণ আমার জন্য পাগল হয়ে থাক।
এইসব তুমি কি বলছ?
আলতাফ হাই তুলতে তুলতে বলল, এতদিন আমি তোমাদের এখানে আছি, কখনো তো আমার জন্য তোমার টান ছিল না। হঠাৎ বিয়ের জন্যে পাগল হয়ে গেলে। পোকারা তোমাকে পাগল বানিয়ে দিল। এরা এইসব পারে।
দুলারী রাগী গলায় বলল, পোকারা এটা করল কেন?
পোকারা করল কারণ ওরা আমাকে খুব পছন্দ করে। ওরা বোধহয় ভেবে বের করেছে–তোমাকে বিয়ে করলেই আমার ভাল হবে। ওরা আমার ভাল দেখেছে।
তোমার পোকা মাকড়ের ব্যাপার আমি মোটেই বিশ্বাস করি না।
আচ্ছা।
এ ধরনের গাঁজাখুরি গল্প আমার সঙ্গে কখনো করবে না।
আচ্ছা।
তুমি ঘুমাতে চাইলে ঘুমাও, আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
আচ্ছা।
আলতাফ পাশ ফিরল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। বাকি রাতটা দুলারী কাটালো নির্ঘুম। নানান অদ্ভুত চিন্তাভাবনা তার মাথায় আসতে লাগল। যেন সে একটা পোকা হয়ে গেছে। খুব সুন্দর একটা পোকা। অনেকেই তাকে দেখতে আসছে। আলতাফও এল! সে মুগ্ধ গলায় কলল, বাহ কি সুন্দর! কি সুন্দর! এই, তোমরা একটা ক্যামেরা নিয়ে আস। আমি দুলারীর একটা ছবি তুলে রাখি।
আলতাফ ছবি তুলছে। কি অদ্ভুত কাণ্ড–আলতাফও একটা পোকা হয়ে গেছে! দুলারী বলল, এই, শোন শোন। আলতাফ পোকাদের ভাষায় বলল, খিছ খিছ খিছ। দুলারী এর মানে বুঝতে পারল। এর মানে হল–দুলারী, হাসিমুখে তাকাও। আমি ছবি তুলছি। ছবি তোলার সময় কেউ এমন গম্ভীর হয়ে থাকে?
পোকাদের ভাষার এই হল মজা। মাত্র তিনটা শব্দ—খিছ খিছ খিছ। অথচ কত কিছু বোঝা যাচ্ছে।
.
০৪.
বজলুর রহমান সাধারণত ফজর ওয়াক্তে জেগে উঠেন। নামাজ পড়ে মর্নিং ওয়াকে যান। ঘণ্টাখানিক হাঁটাহাটি করে নাশতা খান। এই রুটিনের নড়চড় খুব একটা হয় না। আজ হল। গত রাতে বলতে গেলে ঘুম একেবারেই হয়নি। শেষ রাতের দিকে চোখ একটু ধরে এসেছিল, ওম্নি বিশ্রী বিশ্রী স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। স্বপ্নে একটা ধবধবে সাদা রঙের তেলাপোকা এসে তাঁকে ইংরেজিতে বলল, How are you Mr, B, Rahumari? তিনি বাংলায় বললেন, যা, ভাগ। তেলাপোকা বিস্মিত হয়ে বলল (এবার হিন্দীতে), কিয়া তুম আংরেজি নেহি জানতে?
আতঙ্কেই বজলুর রহমানের ঘুম ভেঙে গেল। রাতটা বিছানায় বসে বসেই কাটিয়ে দিলেন।
এখন সকাল ন’টা। তিনি নাশতা খেতে খাবার ঘরে এসেছেন। তাঁর মাথা ভার ভার হয়ে আছে। চোখ জ্বালা করছে। তিনি লক্ষ করলেন, রুটি গলা দিয়ে নামছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। এক টুকরা রুটি মুখে নিয়ে অনেকক্ষণ চিবানোর পর পানি দিয়ে গিলে ফেলতে হচ্ছে। একরাত ঘুম না হওয়ার এত সমস্যা? তিনি বিরক্তমুখে ডাকলেন, মনোয়ারা।
কি?
যদি খুব কষ্ট না হয় তাহলে কাছে এসে একটু শুনে যাও?
মনোয়ারা দ্রুত উঠে এলেন। কুণ্ঠিত গলায় বললেন, কাঁচা আমের আচার বানাচ্ছি। দুলারী কদিন থেকে বলছে। কি জন্যে ডেকেছ?
বজলুর রহমান স্ত্রীকে কি জন্যে ডেকেছেন মনে করতে পারলেন না, তবে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলেন। কারণ তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তার রাতের ঘুমের কোন অসুবিধা হয়নি। গত রাতে কি ঘটেছে না ঘটেছে তাও বোধহয় মনে নেই।
রাতে ঘুম হয়েছিল?
যা গরম! ঘুম কি আসে?
দেখে তো মনে হয় মরার মত ঘুমিয়েছ।
মনোয়ারা হকচকিয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে মরার মত ঘুমিয়ে তিনি অপরাধ করেছেন। বজলুর রহমান বললেন, আলতাফকে ডাক, ওর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
ও তো অফিসে চলে গেছে।
অফিস দশটায়, এখন বাজে ন’টা।
বাস পায় না, ভিড় হয়, এইজন্যে আগে আগে যায়।
দুলারীকে ডাক।
ও তো আলতাফের সঙ্গে গেছে। আলতাফকে বাসে উঠিয়ে কলেজে চলে যাবে।
তিনি থমথমে গলায় বললেন, আলতাফকে কি কোলে করে বাসে তুলে দিতে হয়? মনোয়ারা বললেন, তুমি চট করে রেগে যাচ্ছ। তোমার শরীর মনে হয় খারাপ। দেখি, জ্বর আছে কি-না। ও আল্লা, জ্বর আছে তো। বেশ জ্বর। যাও, বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাক। বজলুর রহমান শোবার ঘরে চলে গেলেন। ঘরে ঢুকেই তাঁর ভ্রু কুঞ্চিত হল। তেলাপোকাটা এখনো ঘুরঘুর করছে। বজলুর রহমানকে দেখে পরিচিত ভঙ্গিতে কাছে এগিয়ে এল। এটা কাল রাতের তেলাপোকা কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। অন্য একটাও হতে পারে। ঘরে তেলাপোকার উপদ্রব হয়েছে পোকা মারার অষুধ কিনতে হবে। আজই কিনতে হবে। এখন কিনে আনলেই হয়। পরে মনে থাকবে না।
বজলুর রহমান জ্বর নিয়েই পোকা মারার অষুধ কিনতে বের হলেন। বাজারে অনেক ধরনের অষুধ আছে–Kill Them, Finish, Rouche Killer, vanish. তিনি কিনলেন দুফাইল কিল দেম। নামটা সুন্দর! কিল দেম। তাদের মার, শুধু মার, মেরে শেষ করে দাও। শুওরের বাচ্চা। এদের শুওরের বাচ্চা কলা ঠিক না। এরা তারচেয়েও খারাপ। কিল দেম বোতলের গায়ে লেখা–এটি বিষাক্ত অষুধ। স্প্রে করার সময় হাতে গ্লাভস পরে নেবেন। রাতের বেলায় ঘরের কোণায়, কমোডে, বেসিনে, ভাড়ার ঘরে ছড়িয়ে দেবেন। পরপর তিনবাত অষুধ দেবেন। পনেরো দিন বিরতির পর আবার অষুধ দেবেন।