মামা আমাকে স্নেহ করেন। তা ছাড়া অদ্ভুত কথা তো কিছু বলি নাই।
বাবা তোমাকে মোটেই স্নেহ করেন না। সারাক্ষণ গাধা ডাকেন।
আলতাফ হাই তুলতে তুলতে বলল, ঘুম পাচ্ছে, চল শুয়ে পড়ি।
দুলারী বলল, তুমি আমার একটা কথা শোন। এইসব কথা তুমি কাউকে বলবে না। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
আলতাফ বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, আমি নিজ থেকে বলি না, মামা জিজ্ঞেস করলেন,..
জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলবে না। তোমাকে নিয়ে কেউ হাসাহাসি করলে আমার ভাল লাগে না। রাগ লাগে, কান্না পায়।
আলতাফ পাশ ফিরতে ফিরতে সহজ গলায় বলল, পোকাগুলি তো সারাক্ষণ হাসাহাসি করে।
করুক। ওদের হাসি তো আর কেউ বুঝতে পারছে না।
আলতাফ কিছু বলল না। ঘর নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। দুলারী বলল, ঘুমিয়ে পড়েছ?
আলতাফ জবাব দিল না। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। হাত-পা লম্বালম্বি ছড়ানো। মনে হচ্ছে তালগাছের একটা লম্বা গুঁড়ি। এই এক ঘুমেই সে রাত কাবার করে দেবে। সকালে দূলারী জেগে ওঠে দেখবে–আলতাফ একই ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। দুলারী ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল। তার আরো কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছা ছিল।
মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবু গরম কমছে না, গরমে মাথা ধরে যাচ্ছে। মশা কামড়াচ্ছে। মশারা এখন আর আলতাফের কথা শুনছে না। দুলারী মনে মনে হাসল। মানুষটা কি অদ্ভুত বিশ্বাস নিয়েই-না আছে–পোকারা তার কথা শুনে। অবশ্যি এরকম বিশ্বাস থাকা দোষের কিছু না। তার এই বিশ্বাসে তো কারো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। আলতাফের চেয়েও কত ভয়ংকর সব বিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীতে লোকজন বাস করে। নিজের প্রস্রাব নিজেই গ্লাসে করে খেলে ফেলছে–এতে নাকি শরীর রোগহীন হয়। আরেকবার দুলারী পত্রিকায় পড়েছে, শিকাগোতে এক লোক আট বছর বয়েসী একটা মেয়েকে খুন করে তার জরায়ু বের করে খেয়ে ফেলেছে। এতে নাকি যৌবন অক্ষয় হয়। এদের তুলনায় আলতাফের বিশ্বাস তো খুব সাধারণ। তাছাড়া কে জানে আলতাফ হয়তো পোকাদের কথা বুঝতেও পারে। অসম্ভব কিছু না। সোলায়মান পয়গম্বর পৃথিবীর সব পশু-পাখিদের কথা বুঝতেন।
দুলারী পাশ ফিরলো। মশা খুব কামড়াচ্ছে। টেবিলের উপর একটিন মর্টিন আছে। স্প্রে করে ঘরে ছড়িয়ে না দিলে মশারা তাকে ঘুমুতে দেবে না। দুলারী সাবধানে বিছানা থেকে নামল। টেবিলটা কোন দিকে দুলারী বুঝতে পারছে না। অন্ধকার হলেই মানুষ দিকহারা হয়ে পড়ে। পশ্চিমকে মনে হয় উত্তর, উত্তরকে মনে হয় দক্ষিণ।
দুলারী অষুধ স্প্রে করে দিল। ঘরে এখন হাসপাতাল হাসপাতাল গন্ধ। নাক জ্বালা করছে। মশার কামড়ের চেয়ে নাক জ্বালা বরং ভাল। দুলারী বিছানায় ফিরে এলো। আলতাফ অস্ফুট শব্দ করল। বিড়বিড় বিড়বিড় করে কি যেন বলে যাচ্ছে। দুলারী বলল, কি বলছ? আলতাফ লল, হুঁ।
ঘুমুচ্ছ?
হুঁ।
মশার অষুধ দিয়েছি। তোমার খারাপ লাগছে না তো?
হুঁ।
আজ একেবারে গায়ে ফোসকা পড়ে যাবার মত গরম পড়েছে।
হুঁ।
ইচ্ছে করছে গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলতে।
হুঁ।
দুলারী জানে এই হুঁ অর্থহীন। যাই জিজ্ঞেস করা হোক আলতাফ বলবে–হুঁ। ঘুমের মধ্যেই বলে যাবে। দুলারীর ঘুম আসছে না। একা জেগে থাকা বেশ কষ্টের। জেগে থাকলেই কথা বলতে ইচ্ছা করে। ঘুমন্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলার কোন মানে হয় না, তবে আলতাফ ঘুমের মধ্যেই হুঁ হুঁ করে, এও মন্দ না।
এই শোন।
হুঁ।
অফিসে তোমার কাজকর্ম কেমন হচ্ছে?
হুঁ।
কেউ আবার ভাবছে না তো তুমি পাগল কিংবা বোকা?
হুঁ।
আমি একদিন তোমাদের অফিসে যাব। তোমাকে জানিয়ে যাব না, না জানিয়ে যাব। চুপি চুপি যাব। বোরকা পরে যাব যাতে তুমি চিনতে না পার। নিজের চোখে দেখে আসব তুমি কি কর।
হুঁ।
তোমাদের অফিসে ক্যানটিন আছে? থাকলে ক্যানটিনে চা খাব।
গরম যেন আরো বাড়ছে। গা বেয়ে ঘাম ঝরছে। দুলারীর মনে হল, গায়ের কাপড় খুলে ফেললে কেমন হয়? অন্ধকারে কে আর দেখতে আসছে? আলতাফ যে জেগে উঠবে তাও না। আর জাগলেও বাতি জ্বালবে না। দূলারী তার গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলল। এখন একটু আরাম লাগছে। গায়ে বাতাস লাগছে। আবার নিজেকে কেমন জানি পোকাপোকা লাগছে। পোকাদের গায়ে কোন কাপড় থাকে না। আলতাফ বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। কি বলছে সে? দুলারী শোনার চেষ্টা করছে। অর্থহীন সব শব্দ–কিছু খিচ ঝিঝ ঝিঝ। পোকারা কি এমন শব্দ করে? দুলারী আলতাফের গায়ে হাত রাখল। কি ঠাণ্ডা শরীর।
এই শুনছ? শুনছ?
হুঁ।
পানি খাবে?
খাব।
তোমার ঘুম ভেঙেছে?
ভেঙেছে।
আলতাফ উঠে বসল। বিস্মিত গলায় বলল, তুমি নেংটো হয়ে শুয়ে আছ
ঘর অন্ধকার, আলোর সামান্যতম ইশারাও নেই। এর মধ্যে মানুষটা বুঝলো কি করে তার গায়ে কাপড় নেই? দুলারী অস্বস্তির সঙ্গে বলল, বড় গরম!
আলতাফ বলল, ও আচ্ছা। দুলারী অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে পানির বোতল এবং গ্লাস নিয়ে এল। আলতাফ এক চুমুকে পানি শেষ করেই আবার শুয়ে পড়ল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল। সে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
দুলারীর শরীর জ্বালা করছে। বুক ধক ধ্বক করছে। সে আবারো ডাকল, এই, এই। আলতাফ বলল, কি?
ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?
হুঁ।
এখনো কি ঘুমুচ্ছ? তুমি তো আবার ঘুমের মধ্যেও হুঁ হুঁ কর।
না ঘুমাচ্ছি না।
দুলারী ক্ষীণ স্বরে বলল, তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে।