ভয়ের চোটে ওরা কি করে? তোকে দেখলেই স্লামালিকুম দেয়?
তা না, তবে ডাকলে আসে।
বজলুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনলে তো, আলতাফ ডাকলেই পোকারা যে যেখানে থাকে ছুটে আসে। মনোয়ারা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, আরেকদিন এইসব নিয়ে কথা হবে। আজ রাত অনেক হয়েছে। তিনি হাই তোলার ভঙ্গি করলেন।
বজলুর রহমান বললেন, রাত যতই হোক ব্যাপারটার ফয়সালা হওয়া দরকার। আলতাফ, দেখি তুই তোর এক পোকা ডেকে আন।
একটা তেলাপোকা ডেকে আনব মামা?
ডাক, তেলাপোকাই ডাক। তেলাপোকাই বা খারাপ কি?
আলতাফ চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উড়তে উড়তে ঘরে একটা তেলাপোকা ঢুকল। বসল সিলিং ফ্যানের পাখায়।
আলতাফ বলল, এই, নিচে নাম।
পোকা নিচে নামল। বসল মেঝেতে। আলতাফ বলল, শুঁড় দুটা নাড় তো।
তেলাপোকা শুঁড় নাড়াতে লাগল। বজলুর রহমান নিজের অজান্তেই আয়াতুল কুরসি সুরাটা মনে মনে পড়ে ফেললেন।
আলতাফ বলল, মামা, একে কি চলে যেতে বলব?
বল।
আলতাফ বলল, চলে যা।
পোকা গেল না। শুঁড় নাড়তে লাগল। একবার পাখা তুলে উড়ার ভঙ্গি করল। আবার পাখা নামিয়ে ফেলল।
মনোয়ারা বললেন, কই, যাচ্ছে না তো।
যেতে চাচ্ছে না মামী। এরা সবসময় কথা শুনে না।
তেলাপোকা চক্রাকারে ঘুরছে। আলতাফ বলল, এই, ঘোরা বন্ধ কর।
ঘোরা থেমে গেল।
যা, চলে যা।
পোকা নড়ল না। স্থির হয়ে গেল।
বজলুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, যেতে না চাইলে কি আর করা! আলতাফ বলল, মামা, আমি যাই? ঘুম পাচ্ছে।
বজলুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, যা।
আলতাফ উঠে চলে গেল। বজলুর রহমান এবং মনোয়ারা দুজনের কেউই অনেকক্ষণ কোন কথা বললেন না। চুপচাপ বসে রইলেন। মনোয়ারা প্রথম নীরবতা ভংগ করলেন। ফিসফিস করে বললেন, এটা কি হল?
বজলুর রহমান রাগী গলায় বললেন, কিসের কথা বলছ?
পোকা তো সত্যি সত্যি ওর কথা শুনে।
কোন কথাটা শুনেছে?
ওর কথা শুনে পোকা ঘরে এসেছে।
তোমারও কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? পোকা কথা শুনবে মানে? কাকতালীয়ভাবে একটা তেলাপোকা ঘরে এসেছে। এই হল ব্যাপার। ঝড়ে বক মরে গেছে, আর ফকির সাহেব বললেন, দেখলি, দোয়া কুনুত পড়ে ফুঁ দিলাম আর বক মরে পড়ে গেল। ব্যাপার এর বেশি কিছু না।
শুঁড় মাড়িতে বলল, শুঁড় নাড়ল।
কি যন্ত্রণা! পোকা শুঁড় নাড়ে না? কুকুর যেমন লেজ নাড়ে পোকা নাড়ে শুঁড়। ওদের কাজই হল শুঁড় নাড়া।
আমার ভয়-ভয় লাগছে।
ফালতু কথা বলবে না। ভয়ের এর মধ্যে কি আছে?
বজলুর রহমান ঘুমুতে গেলেন। তাঁর ভাল ঘুম হল না। রাতে কয়েকবার উঠলেন। পানি খেলেন, বাথরুমে গেলেন। যতবারই বাথরুমে গেলেন ততবারই লক্ষ্য করলেন–তেলাপোকাটা যায়নি। মেঝেতে ঘুরঘুর করছে। অবশ্যি এটা আগের পোকা নাও হতে পারে। হয়তো অন্য একটা। চায়নিজদের মত সব তেলাপোকাও দেখতে একরকম। একটার সঙ্গে অন্য একটা আলাদা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। তাঁর মনে হল পোকাটী তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু যে তাকিয়ে আছে তাই না, ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁকে দেখার চেষ্টা করছে। তিনি পোকাটার গায়ে থু করে থুথু ছিটিয়ে দিলেন, তারপরেও সেটা নড়ল না বরং তাঁর দিকে খানিকটা এগিয়ে এল। এ কি যন্ত্রণা! তিনি বললেন, যা হারামজাদা।
পোকাটা থমকে গেল। এখন আবার শুড় নাড়ছে।
শুঁড় নাড়া বন্ধ কর হারামীর বাচ্চা।
পোকাটা শুঁড় নাড়া বন্ধ করল। বজলুর রহমান এক দৃষ্টিতে পোকাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
০৩.
আজ অসহ্য গরম। বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল, এতে গরম আরো বেড়েছে। এই গরমেও আলতাফের ঘরের দুটি জানালাই বন্ধ। শুধু যে বন্ধ তাই না, পর্দাও টেনে দেয়া। জানালা খোলা রেখে আলতাফ ঘুমুতে পারে না। ঘরে আলো থাকলেও সে ঘুমুতে পারে না। আলতাফের অভ্যাসে দুলারী অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে, এখন আর তার খারাপ লাগে না। এই ঘরের সঙ্গে এটাচড বাথরুম আছে। বাথরুমও অন্ধকার। চল্লিশ পাওয়ারের একটা বাস্তু ছিল, আলতাফ সেই বাল্ব খুলে রেখেছে। অন্ধকারে আলতাফের অসুবিধা হয় না, তবে দূলারীর হয়। সে একটা টর্চলাইট নিয়ে বাথরুমে মায়।
আজকের অন্ধকার অন্য রাতের চেয়েও বেশি, কারণ বাসার সামনে স্ট্রীট ল্যাম্পের বাল্ব আবার চুরি হয়েছে। অন্ধকার বাথরুমে আলতাফ হাত-মুখ ধুচ্ছে। দূলারী খাটের উপর মশারি খাটাচ্ছে। আন্দাজের উপর খাটাচ্ছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দুলারী বলল, আজ খুব গরম।
আলতাফ বলল, হুঁ।
একটা জানালা খুলে দেই?
না।
মশারীর ভেতর ফ্যানের বাতাস ঢুকে না। গরম লাগে।
মশারি খাটিও না।
মশারি না খাটালে উপায় আছে? মশা খেয়ে ফেলবে না?
মশা খাবে না, ওদের না করে দেব।
আলতাফের কথায় অন্য কেউ চমকে উঠতো, দুলারী চমকাল না, এরকম কথা সে প্রায়ই শুনে। দুলারী মশারি খুলে ফেলল। আলতাফ তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরুল। দুলারী বলল, বাবা তোমাকে কেন ডেকেছিলেন?
পোকাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন।
তুমি বলেছ?
হুঁ।
কেন বলেছ?
মামা জানতে চাইলেন তাই বললাম। না বলার কি আছে?
বাবা কি তোমার কথা বিশ্বাস করেছেন?
বিশ্বাস করবেন না কেন?
আমার মনে হয় না বাবা তোমার কথা বিশ্বাস করেছেন। তোমাকে নিয়ে এখন নিশ্চয়ই মার সঙ্গে হাসাহাসি করছেন। সাধারণ কিছু বললেই বাবা হাসাহাসি করেন, আর এখন বলছ অদ্ভুত কথা।