মাসখানিক কেটে গেল, চাকরি যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সকাল আটটায় টিফিন বক্সে টিফিন নিয়ে আলতাফ রওনা হয়। আলতাফের সঙ্গে যায় দূলারী। সে তাকে বাসস্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। দুলারীর হাতে থাকে একটা চটের ব্যাগ। সেই ব্যাগে থাকে একটা পানির বোতল, ছোট্ট ফ্লাস্কে এক কাপ গরম দূধ এবং এক কৌটা পানের মশলা।
দুলারীর কাণ্ড কারখানায় বজলুর রহমান বড়ই বিরক্ত। মনোয়ারাকে একদিন ডেকে বলে দিলেন, দুলারী সঙ্গে যায় কেন? গাধাটা কি বাসস্টপ চেনে না? দুলারীকে নিষেধ করে দেবে। বাড়াবাড়ি আমি পছন্দ করি না। ঢং বেশি হয়ে যাচ্ছে।
মনোয়ার নিষেধ করেছেন। আদুরে গলায় বললেন, কি দরকার রোজ রোজ সাথে যাওয়ার? তোর বাবা রাগ করে।
দুলারী হাই তুলতে তুলতে বলেছে, করুক রাগ।
বাড়াবাড়ি বেশি হচ্ছে।
মোটেই বেশি হচ্ছে না। তুমি তা ভাল করেই জান।
বাড়াবাড়ি বেশি হচ্ছে না এটা অবশ্যি সত্যি। স্বামীকে নিয়ে ঢলাঢলি, ছাদে হাঁটাহাটি, অকারণ হাসাহাসি এইসব কিছুই হচ্ছে না। সন্ধ্যা না হতেই দরজা বন্ধ করে এরা গুজগুজ করে গল্পও করে না। খুব অন্যায় জেনেও তিনি কয়েকবার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখেছেন। আলতাফ চেয়ারে ঝিম ধরে বসে থাকে। দুলারী নিজের কাজ করে। যেন কেউ কাউকে চেনে না। বজলুর রহমান সব শুনে বলেছেন, ঝিম ধরে বসে থাকে না, ঘুমায়। চতুষ্পদ জন্তুরা ঘুমায় দাঁড়িয়ে। ও ঘুমায় বসে। এইটুকুই যা তফাৎ। আর কোন তফাৎ নেই। মনোয়ারা একদিন কথায় কথায় দুলারীকে জিজ্ঞেসও করে ফেললেন, আলতাফ কি চেয়ারে বসে বসে ঘুমায় নাকি রে?
দুলারী বিরক্ত হয়ে বলেছে, চেয়ারে বসে ঘুমুবে কেন? এইসব কি আজেবাজে কথা বল?
প্রায়ই দেখি চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে থাকে।
তাতে অসুবিধা কি?
না, অসুবিধা আর কি। দেখতে খারাপ লাগে।
তোমাকে দেখতে বলেছে কে?
তুই এমন ক্যাট ক্যাট করছিস কেন? আমি একটা কথার কথা বললাম।
ওকে নিয়ে তোমরা সারাক্ষণ সমালোচনা কর আমার ভাল লাগে না। বেচারা কারো সাতে নেই পাঁচে নেই, চুপচাপ থাকে, আর তোমরা …
কি যন্ত্রণা! কেঁদে ফেলছিস কেন? আমরা কি এমন বললাম?
বাবা তো তাকে সারাক্ষণই গাধা বলছে। চুপচাপ থাকলেই মানুষ গাধা হয়ে যায়? চুপচাপ থাকাটা কি অপরাধ?
অপরাধ হবে কেন? একেবারে ঝিম ধরে থাকে তো, তাই…
মোটেই ঝিম ধরে থাকে না, বসে বসে ভাবে।
কি ভাবে?
নানান কিছু নিয়ে ভাবে, তোমরা বুঝবে না। ও পোকাদের নিয়ে ভাবে।
পোকাদের নিয়ে ভাবে!
হ্যাঁ। পোকা-মাকড় এইসব নিয়ে ভাবে।
মনোয়ারা শুকনো গলায় বললেন, পোকা-মাকড়দের নিয়ে ভাবা তো ভাল কথা। শুনে খুব আনন্দ হচ্ছে।
তুমি আবার বাবাকে এসব বলতে যেও না। বাবা কি বুঝতে কি বুঝবে। বাবা তো আবার সবকিছু বেশি বুঝে।
আরে না, তোর বাবাকে সব কথা বলার দরকার কি? পুরুষ মানুষকে সব কথা বলতে নেই, এতে সংসারের শান্তি নষ্ট হয়। তা ইয়ে, আলতাফ কি দিনরাত পোকাদের নিয়েই ভাবে?
দুলারী বিরক্ত গলায় বলল, দিনরাত পোকাদের নিয়ে ভাববে কেন? ওর কি আর কাজকর্ম নেই? মাঝেমধ্যে ভাবে। তুমি আবার বাবাকে কিছু বলতে যেও না।
পাগল হয়েছিস, তাঁকে বলার দরকার কি?
মনোয়ারা সেই রাতেই স্বামীকে ফিসফিস করে পোকার ব্যাপারটা বললেন।
বজলুর রহমান বললেন, আরে, গাধাটার তো ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে। পোকা নিয়ে ভাবে মানে? পোকা নিয়ে ভাবার কি আছে? গাধাটাকে ডাক।
থাক, ভাকতে হবে না।
অবশ্যই ডাকতে হবে। অবহেলা করার ব্যাপার এটা না।
পরে একসময় ওকে আলাদা করে ডেকে … মানে দুলারী যাতে কিছু বুঝতে পারে।
বজলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, কোন রকম আর্গুমেন্টে যাবে না। আই হেট আর্গুমেন্ট। তুমি গাধাটাকে ডেকে আন। আজই এর ফয়সালা হওয়া উচিত। পোকাদের নিয়ে ভাবে, পোকাদের রবীন্দ্রনাথ হয়েছে। হারামজাদা!
মনোয়ারা ডাকতে গেলেন। দুলারী বলল, এই রাতদুপুরে বাবা ডাকছে কেন?
মনোয়ারা ক্ষীণ গলায় বললেন, ঐ অফিসে কাজকর্ম কেমন হচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করবে।
তুমি পোকার ব্যাপার বাবাকে কিছু বলনি তো?
না।
আলতাফ মামার ঘরে ঢুকে ভয়ে ভয়ে বলল, মামা ডেকেছেন?
বজলুর রহমান বললেন, বোস। মামা ভাকবি না, খবর্দার।
কি ডাকব?
কিছুই ডাকতে হবে না। ডাকাডাকির পালা শেষ।
আলতাফ বসল। বজলুর রহমান গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, তুই নাকি পোকাদের নিয়ে ভাবিস?
জ্বি মামা?
কি ভাবিস?
তেমন কিছু না, মামা। ওদের সঙ্গে কথা টথা বলি, ওরা যখন চুপ করে থাকে তখন ভাবি।
বজলুর রহমান হতভম্ব হয়ে বললেন, ওদের সঙ্গে কথা বলিস?
জ্বি মামা।
কবে থেকে কথা বলাবলি শুরু হয়েছে?
যখন আপনার এখানে আসলাম তখন থেকে।
আমার এখানে এসেছিস দুবছর বয়সে, তখন থেকে পোকাদের সঙ্গে তোর দোস্তি?
দোস্তি না মামা। ওরা যে আমাকে ঠিক পছন্দ করে তা না। সবাই আমাকে ভয় পায়। ভয়ের কারণে কিছু কিছু কথা শুনে।
পোকারা তাহলে তোর ভয়ে কম্পমান?
আলতাফ হা-সূচক মাথা নাড়ল। বজলুর রহমান মনে মনে বললেন, গাধাটার তো আসলেই ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে। ব্রেইনে ইলেকট্রিক শক দিতে হবে। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘটনা শুনছ তো? পোকারা আমাদের আলতাফকে হেড মাস্টার সাহেবের মত ভয় পায়। আলতাফের ভয়ে তারা থরথরি কম্পমান।
আপনি যত বলছেন ওরা তত ভয় পায় না মামা। কিছুটা ভয় পায়।