বজলুর রহমান রাত এগারোটার দিকে ঠিক করলেন–খোঁজ নিতে যাবেন। যাওয়া হল না। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। বাসার সামনে একহাঁটু পানি জমে গেল। তিনি গেলেন পরদিন।
মোবারকের বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার পর মোবারক দরজা খুলল। পুরোপুরি খুলল না, সামান্য ফাঁক করে ভীত গলায় বলল, কে?
বজলুর রহমান বললেন, আমি। দরজা খোল।
মোবারক দরজা খুলল। তার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কোন কারণে ভয় পেয়েছে। চোখ রক্তবর্ণ। ঠোঁটের পাশ দিয়ে কষ গড়াচ্ছে। তারচেয়ে বড় কথা হাত পা কাঁপছে। মৃত বাড়িতে অনেক লোকজন থাকার কথা। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। একটা মানুষ নেই। তবে ভেতর থেকে বিজ-বিজ শব্দ আসছে।
বজলুর রহমান বললেন, শব্দ কিসের?
মোবারক হোসেন নিচু গলায় কি বলল এক বিন্দু বোঝা গেল না।
বজলুর রহমান বললেন, এ রকম করছ কেন?
ভেতরে এসে দেখেন।
কি দেখব?
বিরাট বিপদে পড়েছি।
বজলুর রহমান মোবারকের সঙ্গেই তার শোবার ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ঘরভর্তি তেলাপোকা। হাজার হাজার বললেও কম বলা হবে–লক্ষ লক্ষ পোকা। তাদের হাঁটা, পাখায়-পাখায় ঘসাঘসি থেকেই বিজবিজ শব্দ আসছে। পোকাদের মাঝখানে শান্তমুখে বসে আছে আলতাফ। তার চোখে ভয় বা বিস্ময় কিছুই নেই। সে বজলুর রহমানকে দেখে দুবার বলল, উ উ।
বজলুর রহমান বললেন, ব্যাপারটা কি?
মোবারক ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, তেলাপোকা।
তেলাপোকা সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কোত্থেকে এল এত তেলাপোকা?
জানি না।
অন্য ঘরেও আছে, না শুধু এই ঘরে?
এই ঘরে। মিনুর ডেডবডি এই ঘরে ছিল। তেলাপোকায় খেয়ে ফেলেছে।
তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
জ্বি না মাথা খারাপ হয় নাই। সত্যি কথা বলতেছি। আপনার কাছে টাকার জন্য গিয়েছিলাম। না পেয়ে মনটা খুব খারাপ হল।
বাবুকে ঘরে রেখে আবার বের হলাম টাকার সন্ধানে।
তাকে তুমি খালি বাড়িতে রেখে গেলে?
জ্বি। ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। ঝড়-বৃষ্টিতে আটকা পড়ে গেলাম। ফিরে দেখি এই অবস্থা।
তুমি একটা দুধের শিশুকে খালি বাড়িতে একটা ডেডবডির পাশে বসিয়ে চলে গেলে!
জি। না গিয়ে তো উপায় ছিল না। হাতে নাই একটা পয়সা।
একটা মানুষ মারা গেছে–কোন লোকজন নাই। এইটাই বা কেমন কথা?
কাউকে বলি নাই তো।
বল নাই কেন?
কি দরকার। বললেই লোকজন এসে গিজগিজ করবে। হেন কথা তেন কথা বলবে। দরকার কি?
তোমার মাথা পুরোপুরি খারাপ।
জি না ভাই সাহেব। মাথা ঠিক আছে।
আমি এই ছেলেকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকদিন থাক আমার এখানে। তুমি অবস্থা ঠিকঠাক করে তারপর নিয়ে যাবে।
জ্বি আচ্ছা।
আর এই নাও এক হাজার টাকা।
আপনাকে এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরত দিয়ে দিব।
ফিরত দিতে হবে না।
আমি ফিরত দিয়ে দিব। এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরত দিব।
মোবারক হোসেন এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা ফিরত দিতে এল না। বরং আরো টাকা ধার করতে এল। সে ন-কি ভয়াবহ ঝামেলায় পড়েছে। পুলিশের ধারণা, সে তার স্ত্রীকে খুন করেছে। তারপর রটিয়েছে তেলাপোকা খেয়ে ফেলেছে।
মোবারক কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, পুলিশ বড় যন্ত্রণা করতেছে ভাইসব। শুধু টাকা চায়।
খুন করেন না কি?
জ্বি না, আমি খুন করব কেন?
তোমার চোখ-মুখ দেখে তো মনে হয় করেছ?
জ্বি-না। তবে পুলিশের ধারণা, করেছি। ৩০২ ধারায় কেইস দিবে বলে মনে হয়। আপনি একটু আমার হয়ে সাক্ষ্য দিবেন।
বজলুর রহমান আঁৎকে উঠে বললেন, আমি আবার কি সাক্ষ্য দিব?
তেলাপোকা যে খেয়ে ফেলেছে এইটা একটু বলবেন। আপনি তো নিজের চোখে তেলাপোকা দেখেছেন।
আমি কিছুই দেখি নাই। টাকা দিতেছি, টাকা নিয়ে যাও। আমি যেন কোন ঝামেলায় না পড়ি।
জ্বি আচ্ছা।
আর শোন, তোমার ছেলে নিয়ে যাও।
জি, নিয়ে যাব। আজকেই নিয়ে যেতাম, আজ আবার এখান থেকে রমনা থানায় যাব। টাকা আপনার কাছ থেকে যা পাব সবটা পুলিশকে দিয়ে দিব। কাল পরশু এসে নিয়ে যাব।
মোবারক আর ফিরে আসেনি। পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। মামলা চলাকালিন সময়ে সে মারা গেছে জেল হাজতে। আলতাফ থেকে গেছে এই বাড়িতে। তার আত্মীয়স্বজন কেউ তাকে নিতে আসেনি। মনে হয় সবাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।
.
০২.
বারই চৈত্র রোববার আজিমপুর কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়ে হয়ে গেল।
আলতাফ আগে থাকতো রান্নাঘরের পাশে খুপড়ি মত জানালাবিহীন একটা ঘরে। বিয়ের পর সে উঠে গেল দোতলায় দুলারীর ঘরে! তার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন বলতে এইটুকুই। তবে স্ত্রীর ভাগ্যের কারণেই হোক কিংবা অন্য যে কোন কারণেই হোক সে একটি চাকরি পেয়ে গেল। ভাল চাকরি, সিটি ব্যাঙ্কের অ্যাসিসটেন্ট কেশিয়ার। বেতন তিন হাজার টাকা, মেডিকেল আছে, যাতায়াতের এলাউন্স আছে।
বজলুর রহমান বললেন, এই গাধাকে যে চাকরি দিয়েছে সে আরো বড় গাধা, রামগাধা। তাকে ঘাড় ধরে দেশ থেকে বের করে দেয়া উচিত।
মনোয়ারা বললেন, এত ঘন ঘন গাধা বলো না তো। দুলারী মনে কষ্ট পাবে!
কষ্ট পেলে পাবে, গাধাকে গাধা বলব না তো কি বলব? ক্যাঙ্গারু বলব?
কিছুই বলতে হবে না, মেয়ের জামাই চাকরি পেয়েছে–এ তো ভাল কথা। বেচারা নিজের চেষ্টায় জোগাড় করেছে। মন্ত্রী-মিনিস্টার ধরাধরি করতে হয়নি। কত আনন্দের ব্যাপার।
আনন্দ দুদিন পর টের পাবে। টাকাপয়সার গণ্ডগোলের জন্যে বাবাজীকে যখন জেলে নিয়ে ঢুকাবে তখন বুঝবে আনন্দ কাহাকে বলে। কয়েকটা দিন সবুর কর, এক সপ্তাহ, এর মধ্যেই রেজাল্ট আউট হয়ে যাবে। এক সপ্তার বেশি যদি গাধাটাকে কেউ চাকরিতে রাখে, আমি নিজের কান কেটে কুত্তার লেজে সূতা দিয়ে বেঁধে দেব।