বজলুর রহমান হুংকার দিয়ে বললেন, ঐ গাধা, ফ্যানের দিকে হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? সিলিং ফ্যান আগে কখনো দেখিসনি? চোখ নামা।
আলতাফ চোখ নামাল।
যা আমার সামনে থেকে।
আলতাফ ঘর থেকে বের হয়ে এল। আসন্ন বিয়ের আনন্দে তাকে খুব উল্লসিত বলে মনে হল না। বজলুর রহমান শুকনো মুখে বসে রইলেন। তাঁর মনোকক্টের যথেষ্ট কারণ আছে। দুলারীর বিয়ে বলতে গেলে ঠিকই হয়ে আছে। ছেলের ফুপা ফুপু এসে মেয়ে দেখে হাতে আঙটি পরিয়ে গেছেন। অতি সস্তা ধরনের আঙটি। রঙ দেখে মনে হয় পেতলের। আঙটি সাইজেও ছোট। যাতায়াতি করে ঢুকাতে গিয়ে দুলারীর আঙুলের চামড়া উঠে গেল। হুলস্থূল ধরনের বড়লোকরা উপহারের ব্যাপারে হাড়-কেপ্পন হয়। ওরা হুলস্থূল ধরনের বড়লোক। ছেলের চেহারা ভাল। মাথায় অবশ্যি চুল নেই। এই বয়সে টাক পড়ে গেছে। এটা তেমন গুরুতর কোন সমস্যা না। ছেলেরা মাথার চুল দিয়ে কি করবে? এদের তো আর মাখায় বেণী করতে হবে না? তাছাড়া পয়সাওয়ালা লোকদেরই মাথায় টাক পড়ে। আজ পর্যন্ত তিনি মাথায় টাকওয়ালা কোন ভিক্ষুক দেখেননি। যারা ভিক্ষা করে বেড়ায় তাদের মাথাভর্তি ঘন চুল থাকে।
আলতাফ হারামজাদাটারও মাথাভর্তি ঘন চুল। একসময় সেও ভিক্ষুক-টিক্ষুক কিছু হবে। একে দয়া দেখানো ভুল হয়েছে। বিরাট ভুল হয়েছে। মিসটেক অব দি সেঞ্চুরি।
বজলুর রহমানের ধারণা তিনি ভুল করেন না! এই ভুল এখন ভেঙে গেছে। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছেন। কালসাপকে বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে দেয়া উচিত ছিল না। তিনি শুধু যে আসতে দিয়েছেন তাই না, বলতে গেলে আদর করে ঘরে স্থান দিয়েছেন। তাও দিতেন না। গ্রহের ফেরে এই কাজটা করতে হয়েছে। ঘটনাটা এ রকম–বজলুর রহমানের ছোটবোন মিনুর ছেলে হল আলতাফ।
বজলুর রহমান মিনুকে পছন্দ করেন না। মিনুর স্বামী মোবারক হোসেনকে দু চোখে দেখতে পারেন না। মোবারক হোসেনের একটা ডিসপেনসারি আছে। সেই ডিসপেনসারিতে আয়-উন্নতি বলে কিছু নেই। কারণ ডিসপেনসারি খোলা এবং বন্ধ করার কোন নিয়ম-কানুন নেই। যখন ইচ্ছা হল মোবারক ডিসপেনসারি খুলে বসে আছে। যখন ইচ্ছা ডিসপেনসারি বন্ধ করে বাসায় চলে আসছে। ডিসপেনসারির বেশির ভাগ অষুধ নিজেই খেয়ে ফেলছে। এই হল অবস্থা। মিনু যখন অসুস্থ হল সে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল না। নিজেই চিকিৎসা করে। অষুধ যে বেচে সে নাকি ভাক্তারের বাবা।
ডাবল এ্যাকশান এন্টিবায়োটিক প্লাস উপবাস চিকিৎসাপদ্ধতি নামে তার নিজস্ব চিকিৎসাপদ্ধতি চলল। এই চিকিৎসাপদ্ধতিতে নিরম্বু উপবাসে থেকে এন্টিবায়োটিক খেতে হয়। এতে অষুধের অ্যাকশান না-কি ডাবল হয়ে যায়। শরীরে পুষ্টি না থাকলে–শরীরের জীবাণুদেরও পুষ্টি থাকে না। এরা আধমরা অবস্থায় থাকে–তখন কড়া এন্টিবায়োটিক পড়লে আর দেখতে হবে না।
মোবারক হোসেনের চিকিৎসাপদ্ধতির কারণেই মিনু আঠারোদিন জ্বরভোগের পর মারা গেল। মোবারক হোসেন আলতাফকে কোলে নিয়ে মৃত্যুসংবাদ দিতে এল।
বজলুর রহমান গম্ভীর মুখে মৃত্যুসংবাদ শুনলেন। দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে বললেন, ডাক্তার শেষ পর্যন্ত দেখাওনি?
মোবারক হোসেন বললেন, ডাক্তার আর কি দেখব? ডাক্তাররা কি জানে?
ডাক্তাররা কিছু জানে না। তুমি সব জান?
আপনাদের দোয়ায় অষুধ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে যা শিখেছি, ভালই শিখেছি।
এখন এই দুধের শিশু কে পালবে?
আলতাফের কথা বলছেন? তাকে নিয়ে মোটেই চিন্তা করবেন না। আমিই পালব। তা ছাড়া তাকে দুধের শিশু বলা ঠিক না। দুবছর হয়ে গেছে। কথা প্রায় সবই বুঝে। বলতে পারে না। পিরিচে ভাত মাছ দিলে কপ কপ করে খায়।
ও আচ্ছা।
মোবারক হোসেন অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল, আলতাফ, ইনি তোমার মামা হন। বড় মামা। বল তো–মামা।
আলতাফ বলল, উ ঊ।
মোবারক হৃষ্টচিত্তে বলল, ও এইভাবেই কথা বলে। মামা বলতে বলেছি তো, কাজেই সে দুবার বলেছে উ-উ। কারণ মামা শব্দটায় দুটা অক্ষর। মা বলতে বললে একবার উ বলবে। কারণ মা হল এক অক্ষরের শব্দ।
বাবু বল তো মা।
আলতাফ বলল, ঊ।
মোবারক হোসেন আনন্দিত স্বরে বলল, দেখলেন ছেলের বুদ্ধি।
বজলুর রহমান থমথমে গলায় বললেন, গতকাল তোমার স্ত্রী মারা গেছে। আজ তুমি দাঁত বের করে হাসছ!
অন্য প্রসঙ্গে হাসছি। ছেলের বুদ্ধি দেখে হাসছি। সব বাবারাই ছেলেমেয়ের বুদ্ধির পৱিচয় পেলে খুশি হয়ে হাসে।
তোমার বুদ্ধিমান ছেলেকে নিয়ে তুমি বিদায় হয়ে যাও। আর কোনদিন যেন তোমাকে এ বাড়িতে না দেখি।
জ্বি আচ্ছা। কিছু খরচ-বরচ কি দিবেন?
কি খরচ?
হাত একেবারে খালি। গোর দিতে অনেক খরচপাতি–কাফনের কাপড়ই আপনার দশ গজ। মার্কিন লংক্লথ সস্তাটা হল নিন আপনের পঁচিশ, ..
দূর হও বললাম। দূর হও। ভকভক করে মুখ থেকে কিসের গন্ধ বেরুচ্ছে। মদ্য পান করেছ?
জ্বি না। মদ খাই না। একটু কাশির মত হয়েছিল দুবোতল কফ সিরাপ এক সাথে খেয়ে ফেলেছি। কফ সিরাপে কিছু এলকোহল থাকে। তবে খুব সামান্য।
বজলুর রহমান কঠিন গলায় বললেন, বিদায় হও। বিদায়।
মোবারক হোসেন বিদেয় হল।
বজুর রহমানের রাগ বেশিক্ষণ থাকে না। সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই মনে হল কাজটা ঠিক হয় নি কিছু পয়সা দিয়ে দেয়া উচিত ছিল। বড় ভাই হিসেবে তারও একটা দায়িত্ব আছে। অপ্রিয় হলেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হল–এ জাতীয় লোকদের কোন সাহায্য করতে নেই। এদের সাহায্য করার অর্থই হচ্ছে এদের প্রশ্রয় দেয়া। টাকার অভাবে একজন মৃত মানুষের কবর হবে না এটাও বিশ্বাস্য নয়।