আমার মনে হয় আলতাফ কিছু জানে না। তোমার মেয়েটা শয়তানের ঘোড়া, হাড়-বজ্জাত। বটি দিয়ে কাটতে হয় ওকে কাট।
পালের গোদা আগে শেষ করি। তারপর তোমার মেয়েকে ধরব। আমি এখন কবি নজরুল। আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই। বটি কই? বটি আন।
বটি আনার আগেই আলতাফ হোসেন উপস্থিত হল। বজলুর রহমান বললেন, কোথায় গিয়েছিলি?
রাস্তায় হাঁটতে গিয়েছিলাম, মামা। মাথা জাম হয়েছিল, ভাবলাম একটু হাঁটি।
মাথা জাম হয়েছিল?’
জি মামা।
এখন জাম দূর হয়েছে?
জি না। এখনো আছে।
সারা জীবনের জন্যে জাম দূর করার ব্যবস্থা করছি। এই জীবনে আর জাম লাগবে না।
জ্বি আচ্ছা।
আলতাফ ভেতরের দিকে রওনা হল। বজলুর রহমান হুংকার দিলেন, যাস কোথায়?
ভাত খেতে যাই, মামা।
ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে রাগারাগি করা যায় না। বজলুর রহমান অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন, গম্ভীর গলায় বললেন, যা, ভাত খা! ভাত খেয়ে বিছানা বালিশ নিয়ে বিদায় হয়ে যাবি। এই জীবনে তোর মুখদর্শন করতে চাই না।
আলতাফ অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাব?
কোথায় যাবি আমি কি জানি? যেখানে ইচ্ছা যা। মনোয়ারা, হারামজাদাটাকে ভাত দাও।
আলতাফ ভয়ে ভয়ে বলল, কি হয়েছে মামা?
ভাত খেয়ে আয়, তারপর বুঝবি কত ধানে কত চাল।
আলতাফ বলল, ভাত দিন মামী।
মনোয়ারা বললেন, ভাত টেবিলে বাড়া আছে, নিজে নিয়ে খাও।
আলতাফ ভাত খেল। মামার কথামত সুটকেস গুছাল। মামা তাকে যেতে বলেছেন, কাজেই যেতে হবে। মামার সঙ্গে তর্ক করা বা তার অবাধ্য হওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। বজলুর রহমান বললেন, কোথায় যাবি কিছু ভেবেছিস?
জি না, মামা।
রেল স্টেশনে চলে যা। খবরের কাগজ বিছিয়ে প্লাটফরমে শুয়ে থাকবি?
জ্বি আচ্ছা।
আলতাফ নিচু হয়ে মামাকে সালাম করল। বজলুর রহমানের ইচ্ছা করছিল লাথি দিয়ে শুয়রের বাচ্চাকে চিৎ করে ফেলে দেন, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন। আলতাফ চলে গেল। সারা রাত বজলুর রহমানের ঘুম হল না। কৈ মাছের কাঁটার যন্ত্রণাতেই ঘুম হল না। ভোররাতে ঠিক করলেন, মেডিকেল কলেজে যাবেন। এই যন্ত্রণা পোষার কোন মানে হয় না। মেডিকেল কলেজে একা যাওয়া যায় না, কাউকে সঙ্গে নিতে হয়। তিনি আলতাফের খোঁজে কমলাপুর রেল স্টেশনে গেলেন। সে সত্যি সত্যি একটা ইত্তেফাক বিছিয়ে তার উপর গম্ভীর হয়ে বসে আছে। মামাকে দেখেই সে বলল, কাঁটা এখনো আছে মামা?
হ্যাঁ। কাঁটা তুলতে যাচ্ছি। তুই চল আমার সঙ্গে।
সুটকেস নিয়ে যাব?
নিয়ে যাবি না তো কার কাছে রেখে যাবি?
বজলুর রহমান কাঁটা তুললেন। আলতাফকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। আলতাফের এক হাতে স্যুটকেস, অন্য হাতে কাগজে মোড়া মাছের কাঁটা। মামার গলার কাঁটা সে ফেলে আসতে রাজি হয়নি। কাগজে মুড়ে নিয়ে এসেছে। বাসায় ফিরে বজলুর রহমান স্ত্রীকে ডেকে বললেন, গাধাটার সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে আপত্তি আছে? আপত্তি না থাকলে ঝামেলা চুকিয়ে দাও। মনোয়ারা বললেন, দেখ, তুমি যা ভাল বোঝ। তবে বিয়ে দেয়াই ভাল। তোমার মেয়ে হয়েছে কচ্ছপের মত। কামড় দিয়ে যেটা ধরবে সেটা আর ছাড়বে না। বিয়ে না দিলে শেষমেষ কি করে বসে কে জানে। র্যাটম নিয়ে বসে আছে।
ওর কপালে আছে র্যাটম। জীবন্ত র্যাটম। তোমার মেয়েকে বল, র্যাটমের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে একটা কথা শুনে রাখ–এই মেয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শেষ। বিয়ের পর এদের আমি ঘাড় ধরে বের করে দেব। এই বাড়ির দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ।
ওরা যাবে কোথায়? খাবে কি?
সেটা ওদের ব্যাপার।
বিয়ে কবে দিচ্ছ?
গাধাটাকে জিজ্ঞেস করে একটা তারিখ ঠিক কর।
আলতাফকে জিজ্ঞেস করা হল, সে মাথা নিচু করে বলল, বিয়ে করব না।
বজলুর রহমান কঠিন গলায় বললেন, ফাজলামির জায়গা পাস না! বিয়ে করবি না মানে? তোর ঘাড় বিয়ে করবে।
চাকরিবাকরি নাই।
কোন অজুহাত শুনতে চাই না আগামী রোববার তোর বিয়ে।
জ্বি আচ্ছা, মামা।
হাতে মাছের কাঁটা নিয়ে ঘুছিস কেন? ফেল মাছের কাঁটা।
আলতাফ মাছের কাঁটা ফেলে দিল।
ঘরের ভেতর ফেললি কি মনে করে? যা, রাস্তায় ফেলে দিয়ে আয়।
আলতাফ কাঁটা হাতে বের হয়ে গেল। বজলুর রহমান মনোয়ারাকে বললেন, দুলারীকে গিয়ে বল, রোববারে বিয়ের তারিখ হয়েছে।
মনোয়ারা বললেন, আর একটু চিন্তা-ভাবনা করলে হত না?
একবার যখন বলেছি রোববার, তখন রোববারই হবে। মানুষের জবানের দাম আছে।
কিছু সময় তো লাগবেই। বিয়ের কেনাকাটা করব না?
গাধার সঙ্গে বিয়ের আবার কেনাকাটা কি? কেনাকাটার নামও মুখে আনবে না।
আমাদের একটাই মেয়ে।
একটাই হোক আর দশটাই হোক কেনাকাটা হবে না। এটা আমার ফাইন্যাল কখা। তোমার পছন্দ হলে ভাল, পছন্দ না হলেও ভাল।
আলতাফ ফিরে এসেছে। ভীত চোখে তাকাচ্ছে মামার দিকে। বজলুর রহমান বললেন, কিছু বলবি?
কাঁটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছি, মামা।
আহ! বিরটি কাজ করেছিস। আয় কোলে এসে বোস, আদর করি।
বলেই তার মনে হল, আলতাফ সত্যি সত্যি তার কোলে বসার জন্যে এগিয়ে আসতে পারে। প্রথম শ্রেণীর গাধারা করতে পারে না হেন কাজ নেই।
আলতাফ অবশ্যি মামার কোলে বসার চেষ্টা করল মা। ঘরের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে মাথা চুলকাতে লাগল। তাকে দেখে মনে হতে পারে, ফ্যান কেন ঘুরে এই রহস্য নিয়ে সে এখন চিন্তিত।