চা এসে গেছে। মনসুর সাহেব চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, না, ভাওতাবাজি না। ঐ মেয়েটার নাম পারুল। পারুলের ভাইয়ের আসলেই খুব অসুখ।
গনি থতমত গলায় বলল, আপনি কি করে জানেন?
মনসুর সাহেব শীতল গলায় বললেন, আমি সবকিছুই জানি।
এটি পুরোপুরি সত্যি। মনসুর সহেবের শরীর কাঁপছে। গা ঝিম ঝিম করছে। আসলেই তিনি কোথায় কি ঘটছে সব জানেন। এই তো এখন ওসমানকে দেখতে পাচ্ছেন। সে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে পা দুলাচ্ছে। ওসমানের হাতে একটা বই। বইটার নাম Winter of discontent. ব্যাপারটা সত্যি না মিথ্যা এক্ষুণি বের করা মায়। ওসমানকে টেলিফোন করলেই হয়।
কে তাকে সব জানাচ্ছে? পোকারা জানাচ্ছে? পোকারা কি ঘটছে তা বলে দিচ্ছে?
গনি সাহেব ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, স্যার, আমি একটা ভুল করেছি। আপনার কাছে ক্ষমা চাই স্যার।
যান, ক্ষমা করা হল। চা শেষ না করে চলে যাচ্ছেন কেন? চা শেষ করুন, তারপর যান। গনি সাহেব চুক চুক করে চা খাচ্ছেন। মনসুর সাহেব টেলিফোন করলেন ওসমানকে।
কি করছ ওসমান?
বারান্দায় বসে আছি। কিছু করছি না।
বই পড়ছ না?
বই হাতে নিয়ে বসে আছি, পড়ছি না।
বইটার নাম কি?
Winter of discontent.
সন্ধ্যা সাতটার মত বাজে। অফিসের দারোয়ানরা এবং মনসুর সাহেবের একজন পিওন ছাড়া আর কেউ নেই। মনসুর সাহেব দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসে আছেন। তীর ঘর অন্ধকার। তার বেয়ারা কিছুটা ভয় পাচ্ছে। স্যারের কি হয়েছে? এই অন্ধকারের মধ্যে তিনি বাতি নিভিয়ে বসে আছেন কেন?
তিনি করছেন কি? দেখার বা জানার উপায় নেই। কারণ দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়া। এয়ারকুলার চলছে না। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে না। ঘরের ভেতরটা অসহ্য গরম। তবে গরমে মনসুর সাহেবের খারাপ লাগছে না।
মনসুর সাহেবের ঘর নিকষ অন্ধকার। এই অন্ধকারে তিনি চেয়ারে পা তুলে চুপচাপ বসে আছেন। নিজিকে কিছু প্রশ্ন করছেন–এবং প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছেন।
মনসুর : আমি আমার এই অদ্ভুত ক্ষমতা লক্ষ্য করছি। কোথায় কি ঘটছে আমি সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারছি। ছবির মত দেখছি। এর মানে কি?
উত্তর : তোমার চেতনার বিস্তৃতি ঘটেছে। তোমার চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীময়।
মনসুর : এই চেতনার বিস্তৃতি তো আপনা-আপনি ঘটার কথা না। কেন ঘটল?
উত্তর : আমরা সাহায্য করেছি বলে ঘটল।
মনসুর : তোমরা কারা?
উত্তর : আমরা অতি ক্ষুদ্র প্রাণি। তোমরা যাদের পোকা বল, আমরা তাই। আমাদের এককভাবে কোন বুদ্ধি নেই, কিন্তু আমাদের সমষ্টিগত বুদ্ধি সীমাহীন। বুদ্ধি মানেই ক্ষমতা। তোমাকে আমাদের সেই ক্ষমতার কিছুটা দেখালাম। কেমন দেখলে আমাদের ক্ষমতা?
মনসুর : তোমাদের ক্ষমতা যদি থেকে থাকে তাহলে তা অবশ্যই বিস্ময়কর।
উত্তর : এখনো যদি বলছ? এখনো অবিশ্বাস?
মনসুর : হ্যাঁ, অবিশ্বাস। আমার ধারণা, পুরো ব্যাপারটাই আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা।
উত্তর : আমাদের ক্ষমতার আরেকটা নমুনা তোমাকে দেখাই–তাহলে হয়ত তোমার বিশ্বাস হবে।
মনসুর : আমার বিশ্বাসের জন্যে তোমরা এত ব্যস্ত কেন?
উত্তর : আমরা খুবই ব্যস্ত, কারণ তোমাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। যাদের আমরা পছন্দ করি তাদের আমরা খেয়ে ফেলি। হি হি হি।
মনসুর : আচ্ছা, মানুষ কি তোমাদের শত্রু?
উত্তর : মানুষ আমাদের শত্রুও না, বন্ধুও না। মানুষ এবং পোকা-মাকড় হচ্ছে প্রকৃতির ক্ষুদ্র পরীক্ষার অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ।
মনসুর : সেটা কি রকম?
উত্তর : প্রকৃতি দেখতে চেয়েছিল–কোন প্রাণি শ্রেষ্ঠ? সমষ্টিগত বুদ্ধি যাদের তারা শ্রেষ্ঠ, না একক বুদ্ধির প্রাণি মানুষ শ্রেষ্ঠ।
মনসুর : প্রকৃতি কি দেখল?
উত্তর : আমরা জানি না, কারণ প্রকৃতি প্রশ্নের জবাব দেয় না।
মনসুর : মানুষ একক বুদ্ধির প্রাণি হলেও তার বুদ্ধির একটি সমষ্টিগত দিক আছে। সে অন্যের জ্ঞান গ্রহণ করে।
উত্তর : তা ঠিক, কিন্তু সে একই সঙ্গে সমস্ত জ্ঞান ধারণ করতে পারে না। এটা ভয়াবহ সীমাবদ্ধতা। মানুষ এই সীমা জানে না বলেই সীমাবদ্ধতা জানে না।
মনসুর : পাকারা কি এটা জানে?
উত্তর : জানে এবং পোকারা এমন অনেক কিছু জানে যা মানুষ এখনো কল্পনাও করতে পারে না।
মনসুর : আমাকে কি তা বলা যাবে?
উত্তর : হ্যাঁ, বলা যাবে। কিন্তু তোমার মস্তিষ্ক তা ধারণ করতে পারবে না। মানুষের একক মস্তিষ্কের জন্যে এই জ্ঞান অনেক বেশি ভারী।
মনসুর : আমি জানতে চাই।
উত্তর : কি জানতে চাও?
মনসুর : সবকিছু জানতে চাই।
উত্তর : মূল প্রশ্নের উত্তরটি জানলেই অনেক জানা হবে।
মনসুর : মূল প্রশ্ন কি?
উত্তর : প্রাণ কি? কেন প্রাণ সৃষ্টি হল?
মনসুর : হ্যাঁ বল—আমাকে বল–What is life?
উত্তর : সত্যি জানতে চাও?
মনসুর : চাই। অবশ্যই চাই।
উত্তর : আরো তো প্রশ্ন আছে, সেসবের উত্তর চাও না? যেমন–তুমি কে? তুমি কোত্থেকে এসেছ? তুমি কোথায় যাচ্ছ?
মনসুর : হ্যাঁ চাই, উত্তর জানতে চাই।
উত্তর : সময় কি অ কি জানতে চাও? এই পৃথিবীর সবচে রহস্যময় ব্যাপার হল সময়। সময়টা কি জানতে চাও না?
মনসুর : চাই। উত্তর : আমরা যা জানি সবই তোমাকে জানাব। তোমাকে আমরা আমাদের একজন করে নেব।
মনসুর : তা কিভাবে সম্ভব?
উত্তর : সম্ভব। খুবই সম্ভব। আমরা তোমাকে ছড়িয়ে দেব আমাদের মধ্যে। আগেই তো বলেছি যাকে আমরা পছন্দ করি তাকে আমরা ছড়িয়ে দেই নিজেদের মধ্যে।