বজলুর রহমান চিন্তিতমুখে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটা কেন যেন কাটা কাটা কথা বলছে। ধমক দেবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। দুলারী তাঁর বড়ই আদরের মেয়ে। তাকে ধমক দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া দুদিন পর মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাপের বাড়িতে যে কটা দিন থাকবে আদরে থাকুক।
দুলারী বড়ই খেয়ালি ধরনের মেয়ে। ইন্টারমিডিয়েটে পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দিল। বই নিয়ে বসলেই তার নাকি মাথা ধরে। বজলুর রহমান মেয়ের বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। সে বিয়েও করবে না।
মূর্খ অবস্থায় বিয়ে করব না-কি? শ্বশুরবাড়িতে রোজ কথা শুনতে হবে। আগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি, তারপর বিয়ে।
বজলুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই তো পড়াশোনাই ছেড়ে দিয়েছিস, পাশ করবি কি ভাবে?
মাথাধরা রোগটা কমলেই পড়াশোনা শুরু করব।
চার বছর ঘরে বসে থাকার পর দুলারী আবার কলেজে ভর্তি হয়েছে। নিয়মিত কলেজে যাচ্ছে। রাত জেগে পড়াশোনা করছে। এমন খেয়ালি মেয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা মুশকিল। বজলুর রহমান তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা বাদ দিয়েছেন। মেয়ের সঙ্গে কথা যা বলার তা তিনি মেয়ের মার মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেন। এই যে মেয়ে এখন ক্যাট ক্যাট করে কথা বলছে, তাকে একটা ধমক দেয়া উচিত, তা দিতে পারছেন না। দুলারীকে ধমক দেয়ার সমস্যা আছে। ধমক দিলে সে কিছুই বলবে না, নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবে। তার দরজা বন্ধ মানে ভয়াবহ ব্যাপার। একবার কাঠমিস্ত্রী এনে দরজা কাটাতে হয়েছিল। করাত ফরাত এনে কেলেঙ্কারি কাণ্ড।
দুলারী বলল, বাবা, তুমি কি হোসনে আরা বেগমের লম্বা চুলের কোন সেম্পল এনেছ?
না।
ভুল করেছ। সেম্পল আনা দরকার ছিল।
বজলুর রহমান নিজেকে সামলাতে পারলেন না। স্ত্রীকে বললেন, তোমার মেয়েকে এখান থেকে যেতে বল তো।
দুলারী উঠে চলে গেল। বজলুর রহমান বললেন, ওর কি হয়েছে?
মনোয়ারা চাপা গলায় বললেন, সর্বনাশ হয়েছে।
সর্বনাশ হয়েছে মানে?
খাওয়া শেষ করো, অরপর বলব।
বজলুর রহমান তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে গিয়ে গলায় কৈ মাছের কাঁটা লাগিয়ে ফেললেন। কৈ মাছের কাঁটা কৈ মাছের মতই জীবন্ত হয়ে থাকে, যতই সময় যায় কাঁটা ততই ভেতরের দিকে ঢুকতে থাকে। বজলুর রহমান ব্যথায় অস্থির হলেন। একটু পর পর বলেন, এর চেয়ে মরণ ভাল ছিল। এই সময়ে স্বামীকে দুঃসংবাদ দেয়া ঠিক হবে কিনা মনোয়ারা বুঝতে পারেন না। বজুলুর রহমান যখন বললেন, কি ঘটনা বল। তখন তাঁকে ঘটনা বলতে হল। ঘটনা শুনে বজলুর রহমানের চোখ কপালে উঠে গেল, তিনি কৈ মাছের কাঁটার ব্যথা ভুলে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, হারামজাদা আলতাফ কোথায়? হারামজাদার চামড়া ছিলে লবণ মাখিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেব। ডাক হারামজাদাকে।
মনোয়ারী বললেন, ও বাসায় নেই।
দুলারীকে ডাক।
ওকে ডাকা যাবে না।
ঘটনা আসলেই ভয়াবহ। দুলারী আজ সকাল দশটায় কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে মার কাছে রিকশা ভাড়া চাইতে এসে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেছে, মা, আমি এখন একটা কথা বলব, শুনেই হৈ-চৈ শুরু করবে না। কথাটা হল, আমি আলতাফ ভাইকে বিয়ে করব। হোসনে আরা ফোসনে আরার কথা ভুলে যাও।
মনোয়ারা হতভম্ব গলায় বললেন, কি বললি?
দুলারী বলল, কি বলেছি তা তো শুনেছ। ভাল করেই শুনেছ। আবার জিজ্ঞেস করছ কেন? রিকশা ভাড়া দাও, মা। দশ টাকা দেবে। ছেঁড়া নোট দিও না আবার। একদিন ছেঁড়া নোট নিয়ে যা যন্ত্রণায় পড়েছিলাম।
মনোয়ারা রিকশা ভাড়া এনে দিলেন এবং ভাবলেন দুলারী ঠাট্টা করছে। ঠাট্টা তো বটেই। ঠাট্টা ছাড়া আর কি?
তিনি রোজ দুপুরে শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসের শেষ দশ পাতা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমুতে যান। আজ ঘুমুতে পারলেন না। জোহরের নামাজ পড়লেন এবং মেয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
দুলারী কলেজ থেকে ফিরে সহজ গলায় বলল, পানি দাও তো মা, পিপাসা হয়েছে।
মনোয়ারার বুক থেকে পাষাণ নেমে গেল। যাক, কোন সমস্যা তাহলে নেই। তিনি পানি এনে দিলেন। হাসিমুখে বললেন, আজ কলেজে কি হল রে? দুলারী বলল, কিছু হয়নি। তুমি কি বাবাকে বলেছ?
কি বলব?
কলেজে যাবার আগে তোমাকে যে বলে গেলাম?
কি বলে গেলি?
তুমি ভালই জান কি বলে গেছি। তুমি বাবাকে বলে রাজি করাবে। না হলে…
না হলে কি?
তোমরা রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকব। দরজা খুলব না, ভাত খাব না।
তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?
হ্যাঁ।
তোর বাবা তোকে খুন করে ফেলবে।
খুন করলে খুন করবে।
দুলারী সত্যি সত্যি তার ঘরের দরজা বন্ধ করে ফেলল। অবশ্যি মনোয়ারা দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলল। তবে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমাদের চব্বিশ ঘন্টা সময় দিলাম, মা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কিছু না করলে আমি র্যাটম খাব। এই হল ঘটনা।
বজলুর রহমান বললেন, র্যাটম কি?
র্যাটম হল ইঁদুর-মারা বিষ। ধরে এক ফাইল ছিল, সেটা এখন দুলারীর কাছে।
বজলুর রহমান দীর্ঘ সময় ঝিম ধরে বসে রইলেন। গলায় বিঁধে থাকা মাছের কাঁটার কথা তাঁর মনে রইল না। মনোয়ারা বললেন, এখন কি করবে?
বজলুর রহমান থমথমে গলায় বললেন, হারামজাদাকে আমি খুন করব। হারামজাদা কোথায়?
রোজ তো এই সময় বাসাতেই থাকে, আজ কোথায় যেন গেছে।
মাছ কাটার বটিটা আমার কাছে দাও, তারপর দেখ কি করি। শুওর কা কাচ্চা।