অষুধের তেজ কেমন পরীক্ষা করার জন্যে বজলুর রহমান দিনের বেলাতেই অষুধ স্প্রে করলেন। গ্লাভস ছাড়াই করলেন, তিনি গ্লাভ কিনতে ভুলে গিয়েছিলেন।
Kili Them অষুধ হিসেবে মন্দ না। পোকাটার গায়ে স্প্রে করার সঙ্গে সঙ্গে কাজ হল। পোকাটা একবার উড়ার চেষ্টা করেই চিৎ হয়ে পড়ে গেল। কয়েকবার শুড় নেড়েই স্থির হয়ে গেল। বজলুর রহমান হৃষ্টচিত্তে বললেন, শুয়র কা বাচ্চা। বলেই মরা পোকটির গায়ে আরো কয়েকবার কিল দেম স্প্রে করে দিলেন। তার মনে হিংস্র এক ধরনের আনন্দ হল। অনেক দিন এধরনের আনন্দ পাননি। প্রচণ্ড আনন্দের জন্যেই ঘাম দিয়ে তার জ্বর চলে গেল। ক্ষুধা বোধ হল।
.
দুলারী কলেজ থেকে ফিরতেই মনোয়ারা তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, তোর বাবার সঙ্গে কিন্তু খুব সাবধানে কথা বলবি। খুব সাবধান!
দুলারী ভীত গলায় বলল, বাবার কি হয়েছে?
বুঝতে পারছি না। মনে হয় রাতে গরমের জন্যে ভাল ঘুম হয়নি। সকাল থেকে ছটফট করছে। কি যেন দোকান থেকে কিনে এনেছে। ঘরে ঘরে দিচ্ছে। বোটকা গন্ধ।
জিনিসটা কি?
জানি না। জিজ্ঞেস করিনি। যা মেজাজ করে রেখেছে জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগে। তুই তোর বাবার সঙ্গে সাবধানে কথা বলিস। না ডাকলে কাছে যাবি না।
আচ্ছা।
বজলুর রহমান মেয়েকে ডাকলেন না। দুলারী নিজ থেকেই কৌতূহলী হয়ে বাবার ঘরে ঢুকল। ক্ষীণ গলায় বলল, কেমন আছ বাবা?
বজলুর রহমান জবাব দিলেন মা। মেয়ের দিকে তাকালেনও না। দুলারী বলল, তোমার কি শরীর খারাপ?
না। জ্বর ছিল, এখন নেই।
দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। মা বলছিল তোমার রাতে ঘুম হয়নি। ঘুম না হওয়ারই কথা। যা গরম! আমারও রাতে ঘুম হয়নি।
আলতাফ! আলতাফের ঘুম হয়েছে?
ঘুম নিয়ে তো ওর কোন সমস্যা নেই বাবা। ভরদুপুরে ওকে যদি একটা কম্বল দিয়ে ছেড়ে দাও ও আরাম করে নাক ডাকিয়ে ঘুমাবে।
বজলুর রহমান মেয়ের কথায় তেমন মজা পেলেন না। তাঁর মুখ আরো কঠিন হয়ে গেল। তিনি শুকনো গলায় বললেন, ওর মাথাটা কি খারাপ?
দুলারী হকচকিয়ে গিয়ে বলল, মাথা খারাপ হবে কেন?
কাল রাতে আমাকে বলল, ও পোকাদের কথা শুনতে পায়। পোকারাও ওর কথা শুনে। এইসব হাবিজাবি।
বাবা, এটা হল ওর একটা খেয়াল।
খেয়াল?
হ্যাঁ, খেয়াল। ও অবশ্যি বিশ্বাস করে।
তুই বিশ্বাস করিস?
ফিফটি ফিফটি করি বাবা।
ফিফটি ফিফটি মানে?
কিছুটা করি কিছুটা করি না। মানুষ পোকার কথা কি করে শুনবে এটা যখন মনে হয় তখন বিশ্বাস করি না। আবার যখন দেখি ও মশাদের কামড়াতে নিষেধ করল, ওমনি মশার কামড়ানো বন্ধ করল, তখন কিছুটা বিশ্বাস হয়।
বজলুর রহমান থমথমে গলায় বললেন, মশারা ওর কথায় কামড়ানো বন্ধ করে দেয়? সব গান্ধিবাদী মশা?
দুলারী বলল, সবসময় যে কামড়ানো বন্ধ করে তা না, মাঝে মাঝে করে।
বজলুর রহমান বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, আলতাফের স্থান হওয়া উচিত পাগলাগারদে। শুধু ওর একার না–তোরও। মিয়া বিবি দুজনেরই। কোন মানুষ যদি একনাগাড়ে অনেক দিন পাঁঠার সঙ্গে থাকে তাহলে তার গা থেকে পাঁঠার মত গন্ধ বের হয়। এই-ই নিয়ম। তোর গা থেকেও পাঁঠার মত গন্ধ বেরুচ্ছে।
এরকম করে কথা বলছ কেন বাবা?
তোদের চাবকানো উচিত। তা না করে ভদ্র ভাষায় কথা বলছি। যা আমার সামনে থেকে।
দুলারী কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমি জানি তুমি ওকে দেখতে পার না। আমাকেও না। আমরা তোমার সঙ্গে থাকব না। আলাদা বাসা নেব।
যা ইচ্ছা কর। এখন আমার সামনে থেকে যা।
দুলারী প্রায় ছুটে বের হয়ে গেল।
.
০৫.
আলতাফ মাথা নিচু করে লেজার বই-এ লিখে যাচ্ছে। একটা দশ বাজে, টিফিন টাইম। অফিসের মূল হলঘর প্রায় ফাঁকা। সবাই ভিড় করেছে ক্যানটিনে।
গনি সাহেব আলতাফের পাশের টেবিলে বসেন। তিনি পান মুখে দিতে দিতে বললেন, করছেন কি আলতাফ সাহেব?
আলতাফ হাসল। গনি সাহেব বললেন, একটা থেকে দুটা হচ্ছে রেস্ট পেরিয়ড। রেস্ট পেরিয়ডে কাজ করলে আয়ু কমে যায়। রেস্ট পেরিয়ডে অফিসের কোন কাজ করবেন না। যত জরুরি কাজই থাকুক হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন। পান খাবেন। সিগারেট খাবেন। পা নাড়বেন। খবরের কাগজ পড়বেন। কিন্তু ভুলেও কাজ করবেন না।
জ্বি আচ্ছা।
খাওয়া-দাওয়া করেছেন?
জ্বি।
চা খাবেন না কি? চলুন চা খেয়ে আসি।
আমি দুপুরে চা খাই না।
চায়ের কোন সকাল দুপুর নেই। আসুন তো আমার সঙ্গে।
আলতাফ মাথা নিচু করে বলল, এখন কোথাও যাব না।
গনি সাহেব বিস্মিত হলেন। তাঁর মুখের উপর কেউ কখনো না বলে না। এই অফিসে তিনি অতি জনপ্রিয় একজন মানুষ। পরপর কয়েক বছর ধরেই অফিসার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। তিনি যে নিজ থেকে চায়ের দাওয়াত দিলেন, এটা কম কথা না। কিন্তু মানুষটা বোধহয় এর গুরুত্ব ধরতে পারছে না। মনে হচ্ছে নির্বোধ ধরনের মানুষ। কেউ না বললে তা হজম করা গনি সাহেবের স্বভাব নয়। তিনি আলতাফের সামনের চেয়ার টেনে বসলেন। হাসিমুখে বললেন, অফিসের কাজকর্ম কেমন হচ্ছে?
জ্বি, ভাল হচ্ছে।
অসুবিধা হলে বলবেন।
জ্বি আচ্ছা।
বড় কর্তাদের সাথে ঝামেলা হলেও বলবেন। আগের দিন এখন নেই, বুঝতে পারছেন?
আলতাফ চুপ করে রইল। গনি সাহেবের যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। একটা বোকা বোকা ধরনের লোককে কাছে টানা যাচ্ছে না, এ কেমন কথা? লোকটা কি তার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না? বিপদে না পড়লে বুঝতে পারবে না। বিপদে শিগগিরই পড়বে। তখন ছুটে আসতে হবে তাঁর কাছেই। দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্যাদা বুঝে না, এ তো অতি পুরাতন কথা।