রেশমা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, আমিও তো কিছু বুঝতে পারছি না। মিজান ভাই বললেন, সন্ধ্যার পর অফিসে চলে এস, জরুরি কথা আছে। ভুলে গেলেন। কিনা কে জানে। সম্ভবত ভুলে গেছেন।
সে উঠে দাঁড়াল। জয়দেবপুর ফিরে যাবার বাস ভাড়া তার কাছে নেই। সেটা সমস্যা না। তার মতো রূপবতী মেয়ে যদি কন্ডাক্টরকে নরম গলায় বলে–ভাড়া নাই–কন্ডাক্টর কিছু মনে করবে না। তবে এদের কাছে সত্য কথা বলতে হবে। এদের কাছে বানিয়ে কোনো গল্প বলা যাবে না। একজন অভাবী মানুষ অন্য একজন অভাবী মানুষের অভিনয় চট করে ধরে ফেলে। বাসের কন্ডাক্টরও অভাবী লোক।
আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামতে পারে। রেশমাকে মগবাজার বাসস্টেশন পর্যন্ত যেতে হবে। সে মনে মনে চাইছে বৃষ্টি নামুক। তবে এখন না বাসে ওঠার পর ঝুম বৃষ্টি নামুক। সে বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবা হয়ে বাসায় যেতে চায়। গরমে ঘামে গা ঘিনঘিন করছে।
মানুষের অপ্রয়োজনীয় ইচ্ছা বোধহয় সব সময় পূরণ হয়। বাস থেকে নেমেই রেশম বৃষ্টি পেয়ে গেল। ভালো বৃষ্টি। রিকশাওয়ালারা ঘণ্টা বাজিয়ে আসছে, আসুক, রিকশায় ওঠা যাবে না। প্রথমত টাকা নেই, দ্বিতীয়ত ইচ্ছা করছে না। বৃষ্টিতে ভিজতেও খুব যে আরাম লাগছে তা না। ফোটাগুলো ধারালো বলে মনে হচ্ছে। কেমন যেন গায়ে বিঁধে যাচ্ছে। কিছু কিছু বৃষ্টি নরম করে গায়ে পড়ে, কিছু কিছু বৃষ্টি ধারালো বালির কণার মতো শরীরে বিঁধে যায়। এ রকম কেন হয় কে বলবে?
বাসার কাছাকাছি এসেই রেশমা তার শরীর থেকে ছবির নাম মুছে মিতু হয়ে গেল। এখন সে আর রেশমা না, এখন সে মিতু।
বাসার বারান্দায় মোড়ার উপর মবিন ভাই বাসা। তাঁর পাশে মিতুর বোন ঝুমুর। গালে হাত দিয়ে গল্প শুনছে। ঝুমুর মিতুকে দেখে নি। মবিন প্রথম দেখল এবং আঙুল উচিয়ে ঝুমুরকে দেখাল। ঝুমুর উঠে দাঁড়াল, খুশি খুশি গলায় চেঁচাল–আপা চলে এসেছে, আপা। ঝুমুরের, চিৎকার শুনে তার মা শাহেদা এসে দরজায় দাঁড়ালেন। তাঁর মুখও আনন্দে উজ্জ্বল। তিনি এগিয়ে এসে মেয়ের হাত ধরে নরম গলায় বললেন, ভিজে কী হয়েছিস, ভিজলি কেন? রিকশা নিয়ে চলে এলেই হত।
মিতু মবিনের দিকে তাকাল। মা’র সামনে এই মানুষটির সঙ্গে কথা বলতে তার লজ্জা লাগে। আগে যখন আপনি করে বলত তখন লজ্জা লাগত না। এখন তুমি তুমি করে বলে বলেই লজ্জা লাগে। মিতু বলল, তুমি কখন এসেছ?
মবিন জবাব দিল না। মুখ টিপে হাসল। ঝুমুর বলল, মবিন ভাইয়া বিকেলে এসেছে। আমি বললাম, আপার আজ সেকেন্ড শিফট পর্যন্ত শুটিং, বারটার আগে আসবে না। মবিন ভাইয়া বলেছে অবশ্যই সে আটটার আগে চলে আসবে। উনার কথাই ঠিক হলো। আপা তুমি কাপড় বদলে আস। শীতে কাঁপছ।
মিতু কাপড় বদলাতে গেল। শাহেদা বাথরুমের পাশে তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চাপা গলায় বললেন, মবিন আজ বাজার টাজার করে নিয়ে এসেছে।
কেন?
জানি না কেন? দু’কেজির মতো পোলাওয়ের চাল, খাসির মাংস, বাটার অয়েল। আমাকে বলল, মা আপনার হাতে পোলাও-কোরমা খেতে ইচ্ছা করছে।
রেঁধেছা পোলাও-কোরমা?
হুঁ। ঘরে আদা, গরম মসলা কিছুই নাই… তুই তো টাকা-পয়সাও দিয়ে যাস নি।
গরম মসলা ছাড়াই কোরমা রেঁধেছ?
না। মবিন বলল, আর কী কী লাগবে আমি তো জানি না–একটা কাগজে লিস্ট করে দিন নিয়ে আসি। বুদ্ধিমান ছেলে, আমাদের অবস্থা যে জানে না তা তো না।
তাড়াতাড়ি খাবার দিয়ে দাও মা, প্ৰচণ্ড খিদে লেগেছে।
তুই কি টাকা-পয়সা কিছু এনেছিস? মিতু জবাব দিল না। টাকা-পয়সা নিয়ে কথা বলতে কিংবা টাকা-পয়সা নিয়ে ভাবতে এই মুহুর্তে ভালো লাগছে না। শাহেদা চাপা গলায় বললেন, ও তোর জন্যে কী জানি এনেছে। হঠাৎ করে এইসব কী বুঝলাম না।
শাহেদা না বুঝলেও মিতু বুঝেছে। আজ ১৮ তারিখ, তার জন্মদিন। বাসায় কারোর মনে নেই–তার নিজেরও মনে নেই, কিন্তু মবিন ভাইয়ের ঠিকই মনে আছে। এই এক উপলক্ষ ধরে শুধু শুধু এতগুলো টাকা খরচ করার কোনো মানে হয় না। মিতু তোয়ালে দিয়ে ভিজে চুল জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মবিন একা একা বসে আছে। তাকে কেমন রোগা রোগা লাগছে। মিতু হাসিমুখে বলল, তুমি নাকি আমার জন্যে কী উপহার এনেছ–মা বলল।
হুঁ।
কই উপহারটা দাও।
ঝুমুরের কাছে দিয়েছি।
জিনিসটা কী? বই?
উঁহুঁ। একটা শাড়ি। কমদামি জিনিস, সুতি শাড়ি। রঙটা খুব মনে ধরল।
কী রঙ?
জমিনটা হালকা বেগুনি, পাড় সবুজ।
কালো মেয়েদের জন্যে কখনো বেগুনি রং কিনতে নেই। বেগুনি রঙে কালো মেয়েদের আরো কালো দেখায়। বেগুনি রং আশপাশ থেকে রং শুষে নেয়।
এতসব জানি কীভাবে?
আমাদের মেকআপম্যান, তার কাছে শুনেছি।
আজ তোমাদের শুটিং ক্যানসেল হলো কেন?
নানান কারণ। অন্য কথা বল— তোমার সঙ্গে ছবির গল্প করতে ভালো লাগে না। চাকরি টাকরির কোনো খবর পেয়েছ?
না।
বাজার, উপহার এইসব দেখে ভাবলাম হয়তো কিছু পেয়ে গেছ।
এখনো পাই নি।
তাহলে করছি কী?
আগে যা করতাম, তাই করছি–জ্ঞানের ফেরিওয়ালা। বাড়ি বাড়ি জ্ঞান ফেরি করে বেড়াচ্ছি। প্রাইভেট টিউশ্যানি।
চাকরির ইন্টারভুদ্য দেয়া কি বন্ধ করে দিয়েছ?
না। এখনো দিচ্ছি। আমার ধৈৰ্য আমার দুর্ভাগ্যের মতোই সীমাহীন।
বইয়ের ভাষায় কথা বলবে না। আমার খুবই বিরক্তি লাগে। যা বলার সহজ সাধারণ ভাষায় বলবে।