মিজান বলল, আমরা এখন স্যার করব কী? টাকা বাড়াব?
দেখি।
যদি বলেন সন্ধ্যার পর ফরহাদ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে…।
করা যা ইচ্ছা।
আপনি সঙ্গে গেলে ভালো হয়–স্যার যাবেন?
আজমল তরফদার জবাব দিলেন না। ভুরু কঁচকে বসে রইলেন। শুটিং প্যাকআপ হবার পরেও কেউ যাচ্ছে না। বসে আছে। বিকেল চারটা পর্যন্ত শিফট। এখন বাজছে মাত্র বারটা। সারাদিনের কাজ মাটি হবে–তা তো হয় না। নায়ক ছাড়াও তো অনেক কাজ আছে। সেগুলো করা যায়।
ডাইরেক্টর সাহেব রাগের মাথায় প্যাকআপ বলার পরেও মিজান চোখের ইশারায় বলেছে–প্যাকআপ না, সাময়িক বিরতি। অবস্থা ঠাণ্ডা হলে কাজ আবার শুরু হবে। অবস্থা ঠাণ্ডা হলো না। মিজান যখন ডাইরেক্টর সাহেবের কানে কানে বলল, লাঞ্চ ব্রেকের পর কি স্যার ছোটখাটো দু’একটা কাজ করে ফেলব –তখন আজমল তফাদার প্রচণ্ড ধমক দিলেন, গাধার বাচ্চা, প্যাকআপ হয়ে গেছে তুই দেখছিস না? খালি বেশি কথা–সামনে থেকে যা। আমাকে কাজ শিখায়।
মিজান কুৎসিত ধমকে কিছু মনে করল না। কুৎসিত গালি, তুই তুকারি শুটিং ফ্লোরে চলবে না তো কোথায় চলবে? শুটিং ফ্লোর তো আর শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জ না। মিজান একটু দূরে সরে গিয়ে সিগারেট ধরাল। লাইটম্যানদের ইশারায় জানাল— শুটিং আসলেই প্যাকআপ। লাইট নামানো হচ্ছে। চারদিকে আনন্দময় ব্যস্ততা।
রেশমার বুক ধকধক করছে। তার মন বলছে আজ পেমেন্ট হবে না। গতকাল দু’ শিফট কাজ হয়েছে। পেমেন্ট হয় নি–বলা হয়েছে আজকের কাজ শেষ হলে একসঙ্গে পেমেন্ট। আজ যে অবস্থা তাতে পেমেন্টের কোনো সম্ভাবনা সে দেখছে না। জয়দেবপুর ফিরে যাবার ভাড়া পর্যন্ত নেই। দুদিন হলো ঘরে চাল নেই। আশপাশের দোকান থেকে ধারে আনার উপায় নেই। সবাই টাকা পায়, ধার কেউ দেবে না। তারপরেও সে তিন কেজি চালের ব্যবস্থা করেছিল। আজ টাকা নিয়ে ফেরার পর এক সপ্তাহের চাল-ডালের ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। রেশমা মিজানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মিজান বলল, কী চাস?
পেমেন্ট হবে না মিজান ভাই?
উঁ।
‘উঁ’ শব্দটা মানে কী রেশমা ধরতে পারছে না। ‘হ্যাঁ’ না ‘না’?
খুব অসুবিধায় আছি মিজান ভাই।
আমরা কি খুব সুবিধায় আছি! বেআক্কেলের মতো কথাবার্তা বলিস কী জন্যে? ছবির বারটা বেজে গেছে আর তোর হলো পেমেন্ট? টাকা দরকার ভালো কথা–তার সময়-অসময় আছে না?
বড় অসুবিধার মধ্যে আছি মিজান ভাই।
অফিসে যা, অফিসে গিয়ে মুনশি সাহেবকে বল। এখানে কোনো পেমেন্ট হবে না। সব পেমেন্ট অফিসে।
ম্যানেজার সাহেবকে একটু বলে দেবেন?
আচ্ছা।
মনে থাকবে মিজান ভাই?
হুঁ।
রেশমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। গত মাসে ‘বিনাকা স্টোর’ থেকে খুব কায়দা করে বাজার করেছে। বিনাকা স্টোরের মালিক ইসমাইল সাহেবকে বলেছে, চাচা আজ আমার একটা সুসংবাদ আছে। আমাদের লাস্ট ছবিটা হিট করেছে তো–এই জন্যে সবাইকে বোনাস দেয়া হয়েছে।
ইসমাইল হাই তুলতে তুলতে বলল, ভালোই তো।
আপনার দোকান থেকে তো শুধু ধারেই বাজার করি আজ নগদা-নগদি খরিদ। ভুটানের মরিচের আচার আছে না! আজ ভুটানের একটা মরিচের আচারও কিনব। আছে?
ইসমাইল আবারো হাই তুলে বলল, হুঁ। সে হাই না তুলে কোনো কথা বলতে পারে না।
চাল, ডাল, আটা, ভুটানের মরিচের আচার, সয়াবিন তেল, চা, চিনি সব মিলিয়ে পাঁচ শ তিয়াত্তর টাকা। রেশমা বাজারের সব প্যাকেট একত্র করে দাম দেয়ার জন্যে ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে–হতভম্ব চোখে ভ্যানিটি ব্যাগের দিকে তাকিয়ে রইল।
ইসমাইল সন্দেহজনক গলায় বলল, কি টাকা চুরি গেছে?
না। আনতে ভুলে গেছি। চাচা আমার সঙ্গে কাউকে দিয়ে দিন। বাসা থেকে নিয়ে আসবে। যাবে আর আসবে। আমি রিকশা ভাড়া দিয়ে দেব।
ইসমাইল খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে বলল, কাল দিলেই হবে।
আমি স্টুডিওতে যাবার সময় দিয়ে যাব। আমি সকাল আটটার আগেই যাই—তখন দোকান খোলে না?
দশটার আগে দোকান খুলি না।
তাহলে ফেরার পথে দিয়ে যাব।
আচ্ছা।
রেশমা আর যায় নি। যাবে কীভাবে, হাত খালি। আল্লাহর অসীম মেহেরবানি ইসমাইল তার বাসা চেনে না। বাসা চিনলে লোক পাঠিয়ে দিত।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। রেশমা শুকনো মুখে বসে আছে বাণী কথাচিত্রের অফিসে। মিজান ম্যানেজার সাহেবকে রেশমার পেমেন্টের ব্যাপারে কিছু বলে নি। বাণী কথাচিত্রের ম্যানেজার মুনশি শুকনো মুখে বলেছে–শুটিঙের পেমেন্ট এখন বন্ধ। স্যারের লিখিত অর্ডার ছাড়া পেমেন্ট হবে না। মুনশি কঠিন লোক–কাঁদতে কাঁদতে তার পা জড়িয়ে ধরলেও কিছু হবে না। তারপরেও রেশমা বসে আছে যদি মিজান ভাই চলে আসেন। ইউনিটের লোকেরা ফিল্ম অফিসে দিনের মধ্যে একবার আসেই।
মুনশি বলল, খামাখ্যা বসে আছ কেন চলে যাও।
মিজান ভাই আমাকে থাকতে বলছেন।
তাহলে থাক।
রেশমা মনে মনে হাসল। অভাব তাকে আর কিছু শেখাক বা না শেখাক একটা জিনিস শিখিয়েছে। সুন্দর করে মিথ্যা বলা শিখিয়েছে। পৃথিবীতে সবচে’ সুন্দর করে মিথ্যা কারা বলে–অভাবী মানুষেরা। সবচে’ সুন্দর অভিনয় কারা করে? অভাবী মানুষেরাই করে। সারাক্ষণ তাদের অভিনয় করতে হয়। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে রেশমা অপেক্ষা করছে অথচ সে তার মুখ হাসি হাসি করে রেখেছে। এই অভিনয় মোটেই সহজ অভিনয় না।
রাত আটটায় অফিস বন্ধ হয়ে যায়। আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। মুনশি বলল, কই মিজান সাহেব তো এলেন না।