ক্যান্টিনে গাদাগাদি ভিড়। কলিজির গরম সিঙ্গাড়া ভাজা হচ্ছে। দু’জন বয় সিঙ্গাড়া দিয়ে কুল পাচ্ছে না। রেশমা বসার জন্যে খালি চেয়ার খুঁজছে। দি রোজ মুভিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রডাকশন ম্যানেজার দিলদার খাঁ হাত উঁচু করে আগ্রহের সঙ্গে ডাকল, এই যে ম্যাডাম, এদিকে আসেন।
দিলদার খাঁ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রডাকশান ম্যানেজার হলেও তার মূল কাজ মেয়ে মানুষের দালালি। ফিল্ম লাইনের মেয়েদের প্রতি বাইরের মানুষের আগ্রহ প্রচুর। ভালো অঙ্কের টাকা খরচেও এদের আপত্তি নেই। যোগাযোগটা সমস্যা। দিলদার খাঁ এই সমস্যার সমাধান করে। ভালোমতোই করে। দু’পক্ষ থেকেই তার কমিশনের ব্যবস্থা আছে।
দিলদার বলল, ম্যাডাম, কী খাবেন বলেন?
কিছু না–চা।
শুধু চা খাবেন কেন ম্যাডাম? আমার উপর রাগ করেছেন?
ম্যাডাম ম্যাডাম বলবেন না তো দিলদার ভাই।
মেয়েছেলে মাত্রই আমার কাছে ম্যাডাম। তা সে চাকরানিই হোক কিংবা নায়িকাই হোক। ঐ দেখি ম্যাডামকে দু’টা সিঙ্গাড়া দে।
রেশমা সিঙ্গাড়া খাচ্ছে। খুব সাবধানে খেতে হচ্ছে যাতে ঠোঁটের লিপস্টিক উঠে না যায়। সিঙ্গাড়া খেতে গিয়ে সে টের পাচ্ছে তার খুব খিদে লেগেছে। প্ৰডাকশান থেকে সকালে ভালো নাশতা দেয়া হয়েছিল–কেক, চানাচুর, কলা, একটা মিষ্টি। তারপরেও এতটা খিদে থাকার কথা না।
দিলদার খ্যা রেশমার কাছে ঝুঁকে এসে বলল, ‘প্রেম দেওয়ানা’র শুটিং হচ্ছে?
হুঁ।
রোল কী?
রোল কিছু না।
কোনো ডায়ালগ আছে?
দু’টা ডায়ালগ আছে।
ফিল্ম লাইনে কতদিন হলো?
দু’বছর।
তাহলে তো চিন্তার কথা।
চিন্তার কথা কেন?
দিলদার খাঁ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তোমার চেহারা সুন্দর, বয়স সুন্দর, কথাবার্তা সুন্দর, তিন সুন্দর নিয়েও দু’বছরে যদি কিছু না হয় তাহলে আর হবে না। এক্সট্রা থেকে নায়িকার ছোটবোন, নায়িকার ছোটবোন থেকে নায়িকা। হয় না যে তা নয়, হয়। তবে দু’বছরের মধ্যে হয়। দু’বছরে না হলে–নো হোপ। দু’বছর পার করে দেবার পর ধরে নিতে হবে–এক্সট্রা হিসেবে রাইট ইন, এক্সট্রা হিসেবে লেফট আউট। হা-হা-হা!
হাসছেন কেন? এটা তো হাসির কোনো কথা না।
অবশ্যই হাসির কথা, শ্ৰীদেবীর মতো তোমার চেহারা। এই চেহারায় লাভ কী হলো? এক্সট্রার পার্ট আর মাঝেমধ্যে ক্ষেপ মারা।
আস্তে কথা বলেন দিলদার ভাই।
আস্তেই তো বলছি। শোন ম্যাডাম–বাইরের ক্ষেপ কমায়ে দাও, শরীরের সর্বনাশ হয়ে যায়। ফিল্ম লাইনে শরীরই আসল। মনে ভেঙে গেলে কোনো ক্ষতি নাই, শরীর ভাঙলে সর্বনাশ।
উঠি দিলদার ভাই।
উঠবে কী বস না, চা খাও আরেক কাপ।
না, কাজ আছে।
খাও খাও, আরেক কাপ চা খাও। ঐ ম্যাডামকে আরেক কাপ গরম চা।
সে দ্বিতীয় কাপ চা নিল। দিলদার খাঁ আরো খানিকটা ঝুকে এল। রেশমা অস্বস্তি বোধ করছে। দিলদার খাঁর মূল কাজ যে দালালি এটা কারো অজানা নয়। তার কোনো মেয়ের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলার একটাই অর্থ।
দিলদার খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, আমার বাসার ঠিকানা জান না?
রেশমা ঠিকানা জানে না, তবু বলল জানে।
টেলিফোন নিয়েছি। টেলিফোন নাম্বারটা লিখে রাখো। ইমার্জেন্সি টাকা-পয়সার দরকার হলে টেলিফোন করে দিও। আমার কাছে ভালো ভালো পার্টি আছে। সব ভদ্রলোক। একটাও দু’নম্বরী ভদ্রলোক না—আসল ভদ্রলোক। হাংকি পাংকি নাই।
এইসব কাজ এখন আমি করি না দিলদার ভাই।
দিলদার হাসল। পরক্ষণেই হাসি বন্ধ করে বলল, না করাটা তো ভালো। তারপরেও ধর হঠাৎ টাকা-পয়সার দরকার হয়ে গেল। টাকা তো আসমান থেকে পড়ে না। ব্যবস্থা করা লাগে। বর্তমানের ব্যবস্থা ছাড়াও ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করে রাখতে হয়। আজ তোমার চেহারা আছে, স্বাস্থ্য আছে—দুদিন পরে কি থাকবে? থাকবে না। হঠাৎ একটা বড় অসুখ হয়ে গেল। তখন? পানি পড়া মাগনা পাওয়া যায়, ওষুধ মাগনা পাওয়া যায় না। খরিদ করা লাগে। কাগজ-কলম তোমার কাছে আছে?
না।
কাগজ-কলম আমার কাছেই আছে। টেলিফোন নাম্বার লিখে দিচ্ছি। যত্ন করে রেখে দিও। কখন দরকার হয়–কিছুই বলা যায় না।
উঠি দিলদার ভাই?
আচ্ছা। আমাদের প্রডাকশানের কাজ শুরু হচ্ছে। দেখি সেখানে তোমার জন্যে ভালো কোনো সাইড রোল পাওয়া যায়। কিনা।
ফ্লোরে ফিরে রেশমা হতভম্ব হয়ে গেল
ফ্লোরে ফিরে রেশমা হতভম্ব হয়ে গেল। শুটিং প্যাকআপ হয়ে গেছে। আজমল তরফদার শুকনো মুখে বসে আছেন। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে বলে ফ্যান ঘুরছে না। একজন ফ্লোর-বয় তাকে প্রবল বেগে তালের পাখা দিয়ে হাওয়া করছে। তারপরেও আজমল তরফদার ঘামছেন। ইউনিটের সব লোকজন কেমন যেন গম্ভীর। তারা আশপাশেই ঘোরাঘুরি করছে। শুটিং প্যাকআপ হওয়ার মূল কারণ হলো নায়ক ফরহাদের সঙ্গে ডাইরেক্টর সাহেবের খিটিমিটি হয়েছে। নায়ক এক পর্যায়ে বলেছেন, এই ছবির কাজ করব না। বলেই ফ্লোর থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠেছেন।
আজমল তরফদার ক্লান্ত গলায় বললেন, আজ হোক কাল হোক, এই নখড়ামি যে সে আমাদের সঙ্গে করবে। এটা জানতাম। আমার সঙ্গে তার কোনো খিটিমিটি হয় নি, সে যা বলেছে আমি শুনেছি। তার অন্যায় কথা শুনেও আমি বলেছি, ঠিক আছে–তারপরেও সে ফ্লোর থেকে চলে গেল। ঘটনাটা কী? ঘটনা তোমরা কেউ জান না, জানি আমি। ঘটনা বলি শোন–তার সাথে আমাদের ছবির কনট্রাক্ট হয় দু’বছর আগে। এক লাখ টাকায় কনট্রাক্ট। এক লাখ টাকা পেয়েই সে তখন হাতে আসমানের চাঁদ পেয়েছে। খুশিতে গুলগুলা। এর মধ্যে ঘটনা ঘটল–তার তিনটা ছবি হয়ে গেল সুপারহিট। এক লাখ টাকা থেকে বেড়ে তার রেমুনারেশন এক লাফে হয়ে গেল চার লাখ। আমাদের সঙ্গে আগের চুক্তি–এক লাখের চুক্তি। ব্যাটা গেছে ফেঁসে। এখন চাচ্ছে মোচড় দিয়ে আরো কিছু বের করে নিতে–এই হচ্ছে ব্যাপার। শুভঙ্করের অঙ্ক।