ডাইরেক্টর আজমল তরফদার হাসিমুখে বললেন, অবশ্যই। হারামজাদা স্ক্রিপ্ট রাইটারের মাথার মধ্যে ঘুরে ডিকশেনারি। বিহঙ্গ। বিহঙ্গ আবার কী? মিজান ডায়ালগ ঠিক করে খাতায় লিখে ফেল। ফরহাদ ভাই আপনি রেডি?
হুঁ।
একটা মনিটার দিবেন নাকি?
মনিটার লাগবে না। ডাইরেক্ট টেক।
ওকে লাইটস।
আলো জ্বলল। হিরো বলল, শটটা কী রকম, ক্লোজআপ?
হুঁ।
ক্লোজআপ ভালো হবে না। লং শট থেকে জুম করে ক্লোজে আসুন।
আজমল তরফদার মনে মনে বললেন–হারামজাদা এখন ডাইরেকশনে চলে আসছিস। শটের তুই বুঝস কী?
মনে মনে যা বলা হলো মুখে তা বলা হলো না। মুখে বলা হলো–ঠিক ধরেছেন ফরহাদ ভাই। আপনার শট সেন্স মারাত্মক। লাস্ট ডায়ালগে মুখের উপর জুম করে বিগ ক্লোজআপে চলে যাব–শুধু চোখ। কেমন হবে রে মিজান?
ভালো হবে ওস্তাদ। শটের মতো শট।
জুম লেন্স লাগা। ক্যামেরার পজিশন চেঞ্জ কর।
ক্যামেরার পজিশন চেঞ্জ করে জুম লেন্স লাগাতে সময় লাগল। জুম লেন্স ছিল না। বারি স্টুডিও থেকে ভাড়া করে আনতে হলো। এই ফাঁকে অন্য শট নেয়া যেত। তার জন্যে আবার নতুন করে লাইটিং। সেটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো–গ্যালাক্সি হিরো প্রতিটি শটে নাক গলাবেন। দরকার কী? তার শট না নিয়ে অন্যের শট নিলে তিনি রাগও করতে পারেন। তাঁকে বলা হয়েছে একনাগাড়ে তাঁর কাজ শেষ করে অন্য কাজ ধরা হবে।
গ্যালাক্সি হিরো বললেন, জুম লেন্স আনতে দেরি হবে?
আজমল তরফদার হাই তুলতে তুলতে বললেন, না দেরি হবে না।
এইসব আপনার আগে ব্যবস্থা রাখেন না–শেষ সময়ে দৌড়াদৌড়ি!
অপমানসূচক কথা। তবে গ্যালাক্সি হিরোর এ ধরনের অপমান গায়ে মাখতে নেই। দুধ দেবে গরু, লাথি দেবে, গায়ের উপর পেচ্ছাব করে দেবে। জগতের এই হলো নিয়ম। তবে দিন আসবে–তখন এই হিরোকেই মুখে রং মেখে সারাদিন বসে থাকতে হবে–কখন শটের জন্যে ডাক পড়ে। খুব সহজে সেই ডাক আসবে না।
হাতের বাঁধন খুলে দিন, বিশ্রাম করি।
ডাইরেক্টর সাহেবের ইঙ্গিতে ফ্লোর-ব্যয় হাতের বাঁধন খোলার জন্যে ছুটে গেল। হিরো বিরক্ত মুখে বললেন, কফি দিতে বলেন–নরম্যাল না, এক্সপ্রেসো। ইন্টার্ন প্লাজায় ভালো এক্সপ্রেসো পাওয়া যায়–একজন কাউকে পাঠিয়ে দিন, কাছেই তো।
ফ্লোর-ব্যয় আরেকজন চলে গেল এক্সপ্রেসো কফির সন্ধানে। হিরো চেয়ারে গা এলিয়ে বসতে বসতে বললেন, আজ আমাকে একটু সকাল সকাল ছাড়তে হবে–একটা জন্মদিন আছে, যেতেই হবে। আজমল ভাই, মাইন্ড করবেন না, পরে পুষিয়ে দেব।
আজমল তরফদার মনে মনে কুৎসিত একটা গালি দিলেন। মুখে কিছু বললেন না। তাঁর মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছে। বিকেল চারটা পর্যন্ত শিফট। ব্যাটা এগারটার মধ্যে চলে গেলে কাজ কিছুই হবে না। শিফটের টাকা পুরোটাই যাবে।
আজমল ভাই মুখ বেজার করে বসে আছেন কেন?
না, বেজার হব কেন?
আজ একটু আর্লি যাব ঠিকই কিন্তু পুষিয়ে দেব। দেখবেন টপটপ কাজ নামিয়ে দেব—‘বার্নিং সিন’ কি আজই হবে?
আজমল তরফদার আবার হাই তুললেন। মনে মনে বললেন–ক অক্ষর শূকরমাংস কিন্তু ইংরেজি বুলি বের হচ্ছে—‘বার্নিং সিন’–বার্নিং সিন আমি তোর পাছা দিয়ে…
রেশমার সকাল থেকেই মাথাধরা। কাল রাতে ঐ বুড়ো যখন চলে যেতে বলল, তখনই রাগে তার মাথা ধরে গিয়েছিল। সেই মাথা ধরা এখনো যায় নি। যতই সময় যাচ্ছে ততই বাড়ছে। এখন মনে হয় জ্বর আসছে। তার শট হয়ে গেলে সে বাড়ি চলে যেতে পারত। শট হবে না বলে মনে হয়। না হলেও রাত এগারটা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে। গরম এক কাপ চা খেলে মাথাধরাটা কমত। প্রাডাকশনের কাছে চা চাইলে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এক্সট্রাদের ঘনঘন চা দেবার নিয়ম নেই। তবু চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। চায়ের দায়িত্বে যে ফ্লোর-ব্যয় রেশমা তার কাছে গিয়ে মধুর গলায় বলল, সবুর ভাই, চা দেবেন? খুব মাথা ধরেছে।
চা নাই।
চা আছে। না বলছেন কেন? ছবির শুটিং চা ছাড়া চলে?
সবুর বিরক্ত চোখে তাকাল। ফ্লোর-বয়রা সাধারণত মেরুদণ্ড ছাড়াই জন্মগ্রহণ করে। এক্সট্রারা আশপাশে থাকলে মেরুদণ্ড ফিরে পায়। দিন না এক কাপ চা, অসম্ভব মাথা ধরেছে।
ক্যান্টিনে গিয়া চা খাও।
তাহলে ক্যান্টিনে চা খাওয়ার পয়সা দিন।
ওরে বাপরে! ম্যাডামের মতো কথা।
রেশমা ক্যান্টিনে যাওয়াই ঠিক করল। কাউকে বলে যাওয়া উচিত কিনা সে বুঝতে পারছে না। তার শট এখন নেয়া হবে না। এ ব্যাপারে সে এক শ ভাগ নিশ্চিত। তারপরেও প্ৰডাকশনের কারোর যদি চোখে পড়ে সে আশপাশে নেই অমনি মাথায় আগুন ধরে যাবে। প্ৰডাকশন সব সময় রেগে থাকে–রাগ ঝাড়ার মানুষ দরকার। এক্সট্রারা সেই মানুষ। রেশমা চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর মিজানের কাছে গেল। প্ৰায় ফিসফিস করে বলল, আমার শটটা কখন হবে? মিজান ভুরু কুঁচকে তাকাল যেন এমন অসৌজন্যমূলক কথা সে তার জীবনে শোনে নি।
দেরি হবে?
জানি না।
ক্যান্টিন থেকে এক কাপ চা খেয়ে আসি মিজান ভাই? যাব আর আসব।
মিজান জবাব দিল না। সে মুখ ভর্তি করে পান খাচ্ছিল। ফ্লোরের ভেতরই পানের পিক ফেলল। এত কথা বলার তার সময় নেই।
যাব মিজান ভাই?
মিজান খেঁকিয়ে উঠল—সব সময় বিরক্ত করিস ক্যান? কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান না করলে ভালো লাগে না? কাজের সময় যন্ত্রণা!
রেশমা সরে এল। জুম লেন্স চলে এসেছে। ক্যামেরায় মাউন্ট করানো হচ্ছে। হিরোর হাত খাম্বার সঙ্গে বাধা হচ্ছে। মেকআপম্যান চুল ঠিকঠাক করে দিচ্ছে। চোরাকারবারিদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর ধরনের ধস্তাধস্তির পর সে ধরা পড়েছে। তাতে তার চুলের ভাঁজের কোনো ক্ষতি হয় নি। হিরোর শটে অনেক সময় লাগবে। এই ফাঁকে নিশ্চিন্ত মনে ক্যান্টিনে চা খেতে যাওয়া যায়।