মোবারক সাহেব একটু চমকে গেলেন। এই মুহুর্তে তিনি ঠিক টেলিফোনে কথা বলার কথাই ভাবছিলেন। খুব যারা অনুগত তাদের মধ্যে টেলিপ্যাথিক সেন্স কাজ করে। ব্যাপারটা তিনি আগেও লক্ষ করেছেন। কুকুর তার প্রভুর মুড বুঝতে পারে–কুকুরের মতো যারা অনুগত তারাও পারে।
দাও, টেলিফোনে ধরে দাও।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তিনি হালকা চুমুকে কফি খাচ্ছেন। কফি খেতে তাঁর ভালো লাগছে। ইদরিস এখনো টেলিফোনের লাইন দেয় নি। এখন দেবেও না–স্যারের কফি খাওয়া কখন শেষ হবে। তার জন্য অপেক্ষা করবে। তিনি কফি শেষ করে কাপ টেবিলে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন বাজল। এও কি টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ?
স্যার আমি লোকমান। আপনার শরীর ভালো স্যার?
হ্যাঁ। তুমি কেমন আছ লোকমান?
আপনার দোয়া স্যার।
এত রাতে তোমাকে জাগালাম…
কোনো অসুবিধা নেই স্যার। আমি জেগেই ছিলাম।
জেগে ছিলে কেন?
আমার স্যার একটা অসুখ আছে। রাতে ঘুম হয় না।
জানতাম না তো।
আমাকে খোঁজ করছিলেন কেন স্যার?
শোন লোকমান, কাল দিনের ভেতর তুমি একটা পাসপোর্ট এবং জাপানের ভিসার ব্যবস্থা করতে পারবে?
পাসপোর্ট কোনো ব্যাপার না স্যার।
ভিসা পাওয়া যাবে না?
কাল তো স্যার রোববার–জাপান এম্বেসি বন্ধ। সব ফরেন এম্বেসিই বন্ধ।
ভিসা তাহলে সম্ভব না?
সম্ভব না। এমন কথা তো স্যার আমি বলি নি।
পারবে?
কোন পারব না?
মোবারক সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসলেন। লোকমান বলল, স্যার যাবে কে?
তুমি সকালে চলে এস, তখন বলব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
কত দিন ধরে তুমি রাতে ঘুমুতে পার না?
অনেকদিন স্যার।
অনেকদিন মানে কত দিন?
প্রায় চার বছর।
ও আচ্ছা। টেলিফোন তাহলে রাখি?
জ্বি আচ্ছা স্যার। আমি সকালে চলে আসব।
মোবারক সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রেখে বাথরুমে ঢুকে হাত-মুখ ধুলেন। অনেকক্ষণ ধরে দাঁত ব্ৰাশ করলেন। কফির মিষ্টি স্বাদ মুখে নিয়ে ঘুমুতে যাওয়া যায় না। একটু পান খেতে পারলে হতো। মৌরি দেয়া ছোট্ট এক খিলি পান।
চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। পরপর দু’বার হাই উঠল। শরীরে অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। লোহিত রক্ত কণিকারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে–তারা এখন আর আগের মতো অক্সিজেন নিয়ে ছোটাছুটি করতে পারছে না।
তিনি জানালার ভিনিশিয়ান ব্লাইন্ডগুলো টেনে দিলেন। দিনের আলো যেন ঘরে না ঢোকে। পাঁচ ঘণ্টা তিনি একনাগাড়ে ঘুমুবেন। ফাইভ লং আওয়ার্স। থ্রি হানড্রেড মিনিটস।
পুরোপুরিভাবে বিছানায় যাবার আগে আবারো কী মনে করে ইন্টারকমের বোতাম টিপলেন। ইদরিস সঙ্গে সঙ্গে বলল, স্নামালিকুম স্যার। তার বোধহয় লোকমানের মতো অনিদ্রা রোগ আছে।
ইদরিস!
জ্বি স্যার।
লোকমানের সকালে আসার দরকার নেই। ওকে নিষেধ করে দিও।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
ঘুমের ওষুধ, গরম কফি, সারাদিনের ক্লান্তি সব একসঙ্গে চেপে ধরেছে। তাঁর কেমন যেন একা লাগছে। একটু ভয় ভয়ও লাগছে। একজন কেউ পাশে থাকলে ভালো লাগত। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার সময় একজন কাউকে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। মোবারক সাহেব অস্বস্তি বোধ করছেন। কী একটা জিনিস যেন তাঁকে পীড়া দিচ্ছে। টেপী নামের মেয়েটির শরীরে গন্ধ? হতে পারে। মানুষ চলে যায় কিন্তু সে তার গায়ের গন্ধ রেখে যায়। এই গন্ধ মোবারক সাহেবের পরিচিত–খুবই পরিচিত। এই জন্যেই কি তাঁর অস্বস্তি লাগছে?
কী বিশ্ৰী নাম মেয়েটার! নাম বদলে দিতে বলতে হবে–মেয়েটার জন্যে সুন্দর একটা নাম দরকার–ময়ূরাক্ষী নামটা কেমন? ময়ূরের মতো চোখ। ময়ূরের চোখ কি সুন্দর? তিনি জানেন না। ময়ূর দেখেছেন। কিন্তু ময়ূরের চোখের দিকে বিশেষ করে তাকিয়ে দেখেন নি। মানুষের চোখের তুলনা মানুষের চোখের সঙ্গেই হওয়া উচিত–পাখির চোখের সঙ্গে নয়। গন্ধটা নাকে লাগছে। মোবারক সাহেব পাশ ফিরলেন।
মুখে মেকআপ নিয়ে রেশমা বসে আছে
ন’টা থেকে মুখে মেকআপ নিয়ে রেশমা বসে আছে। ইন্টারকাটে তার একটা ক্লোজআপ যাবে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এক্সট্রাদের ক্লোজআপ কখনো গুরুত্বপূর্ণ হয না। মূল শটগুলো ঠিকঠাক রাখার জন্যে এক্সট্রাদের দু’একটা ক্লোজআপ মাঝে মাঝে চলে আসে।
চোরাকারবারিদের আস্তানার সেট পড়েছে। নায়ক ফরহাদ চোরকারবারিদের হাতে ধরা পড়েছে। তাকে একটা খাম্বার সঙ্গে বাধা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হবে। এই উপলক্ষে চোরাকারবারিদের মধ্যে আনন্দের বান ডেকে যাচ্ছে। মদ খাওয়া হচ্ছে। ফ্লোরে নাচের ব্যবস্থাও আছে। একদিকে ছবির হিরো আগুনে পুড়বে। অন্যদিকে নাচ চলবে। নায়ক ফরহাদের শট নেয়া হচ্ছে, চোরাকারবারিদের শট নেয়া হচ্ছে।
ফরহাদ সুপারহিট নায়ক। পরপর তিনটা ছবি তার হিট করেছে, বিজ্ঞাপনে তার সম্পর্কে লেখা হয়–গ্যালাক্সি হিট রোমান্টিক হিরো–ফরহাদ খান।
সবার নজর হিরোর দিকে। হিরোর হাত বাঁধা বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর মিজান এখন তাকে সিগারেট খাওয়াচ্ছে। জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরছে এবং ঠোঁট থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। ক্যামেরা রেডি করা আছে। হিরোর সিগারেট খাওয়া শেষ হলেই শট নেয়া হবে। হিরো ‘ডায়ালগ’ বলবে। দীর্ঘ ডায়ালগ–
তোরা আমার শরীরকে ধরেছিস। আমার শরীর বন্দি, কিন্তু আমার মন? আমার মন মুক্ত বিহঙ্গীর মতো স্বাধীন। মনকে বন্দি করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো শক্তির নেই।
হিরো সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলল, ডায়ালগ কড়া, ক্ল্যাপ পড়বে। তবে বিহঙ্গী ফিহজী রিকশাওয়ালারা বুঝবে না–পাখি করতে হবে।