মিতু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, অন্ধকারে মূর্তির মতো বসে কী করছিলে?
চিঠি লিখছিলাম?
চিঠি লিখছিলে মানে?
মনে মনে লিখছিলাম। মনে মনে চিঠি লিখতে কাগজ, কলম, আলো কিছুই লাগে না। মনে মনে লেখা চিঠিতে কোনো বানান ভুলও হয় না।
কী হয়েছে তোমার বল তো?
অদ্ভুত একটা চিঠি পেয়েছি। চিঠিটা রেজিস্ট্রি ডাকে ইংল্যান্ড থেকে এসেছে।
খারাপ কিছু?
ভয়ঙ্কর খারাপ। নাও পড়। মিতু চিঠি পড়ছে। মনিব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিতুর দিকে। সে যা ভেবেছে তাই। মিতুর চোখে পানি এসে গেছে। সে আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। ধরা গলায় বলল, দশ হাজার পাউন্ড স্ট্যার্লিং মানে কত টাকা?
ষাট দিয়ে গুণ দাও। গুণ দিলেই বেরিয়ে পড়বে।
তোমার হাতে তো একদম সময় নেই।
মবিন উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ছোটাছুটি করতে করতে জান বের হয়ে যাবে। শোন তোমাকে আগেভাগে বলে রাখছি, যাবতীয় ছোটাছুটিতে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। সিনেমা টিনেমা বাদ দাও। তুমি অনেক কষ্ট করেছ। আর কষ্ট করতে হবে না।
আর কষ্ট করতে হবে না?
অবশ্যই না। আজ এই মুহুর্ত থেকে তোমার যাবতীয় কষ্টের অবসান হলো, ঝুমুরকে নিয়ে বা তোমার মা’কে নিয়েও তোমার চিন্তা করতে হবে না।
সব চিন্তা তোমার?
অবশ্যই। বিয়ের ব্যাপারটা এক সপ্তাহের মধ্যে সেরে ফেলব। বাবা চোখ দেখানোর জন্যে ঢাকা আসবেন, মাও আসবেন। ঝুমুর আছে, তোমার মা আছেন–আমরা আমরাই, বাইরের কাউকে বলার কোনো দরকার নেই। বাইরের কেউ তো নেইও। তুমি যদি তোমার ফিল্ম লাইনের কাউকে বলতে চাও বলবে।
টেপীকে বলব?
মিতু এমনভাবে প্রশ্ন করল যে মবিন চমকে তাকাল। তাকিয়েই রইল। মিতু হাসল। সহজভাবেই হাসল। সেই হাসিতেও কিছু একটা ছিল। মবিন চোখ ফেরাতে পারল না। মিতু বলল, তোমার জন্যে সিগারেট এনেছি। নাও।
মবিন হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিতে নিতে অস্পষ্ট গলায় বলল, মিতু তুমি হঠাৎ করে টেপীর কথা তুললে কেন?
মিতু শান্ত স্বরে বলল, তোমার এত বুদ্ধি। তারপরেও একটা সাধারণ ব্যাপার ধরতে তোমার এত সময় লাগল কেন?
মবিন সিগারেট ধরাল। তার হাত কাঁপছে। তার চোখ-মুখ ফ্যাকাসে। মিতু বলল, আমার ধারণা টেপীকে তুমি অনেক আগেই ধরেছ। তারপরেও না ধরার ভান করে গেছ। নিজের সঙ্গে ভান। নিজেকে প্রতারণা। তাই না?
মবিন কিছু বলল না।
মিতু বলল, এখন বল। আমার দিকে তাকিয়ে বল, এখন কি তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারবে?
পারব।
সত্যি পারবে?
অবশ্যই পারব।
মিতু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমারও মনে হয় তুমি পারবে। কিন্তু বিয়েটা ভালো হবে না। যতবারই আমাকে জড়িয়ে ধরবে ততবারই মনে হবে–আরো অনেকে এই ভঙ্গিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। মনে পড়বে না?
না।
ছেলেমানুষের মতো কথা বলবে না তো মবিন ভাই। তুমি ছেলেমানুষ না। তুমি এখন চোখ-কান বন্ধ করে আমাকে বিয়ে করবে। তার পেছনে ভালোবাসা অবশ্যই আছে। সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞতাবোধও আছে। আমি তোমার দুঃসময়ে তোমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছি। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ। ঠিক কিনা বল?
মবিন চুপ করে রইল। তার হাতের সিগারেট নিভে গেল। মিতু হালকা গলায় বলল, দু’জনের জীবন নষ্ট করে তো লাভ নেই। একজনেরটাই নষ্ট হোক। একজন টিকে থাক। তুমি খুব ভালো দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে কর। তুমি সুখে আছ, আনন্দে আছ–এই দৃশ্য দূর থেকে দেখলেও আমার ভালো লাগবে। একদিন হয়তো তোমার চা বাগানে বেড়াতে যাব। তোমার বাংলোতে বসে তোমার সঙ্গে এককাপ চা খাব। তোমার স্ত্রী, তোমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে ছবি তুলব। সেই আনন্দও কম কি?
মিতুর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে বলল, মবিন ভাই তোমার কাছে রুমাল আছে, দাও রুমাল দিয়ে আমার চোখ মুছিয়ে দাও। আমি এখন চলে যাব।
মবিন সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। হালকা পায়ে নেমে যাচ্ছে মিতু। সে মাথার উপর শাড়ির আঁচল টেনে দিয়েছে। তাকে কেমন বউ বউ লাগছে। চারদিকের বিপুল অন্ধকারে মিশে যাবার জন্যে নেমে যাচ্ছে অপূর্ব একটি মেয়ে। তাকে কি এইভাবে নেমে যেতে দেয়া উচিত?
মবিন কঠিন গলায় ডাকল, মিতু দাড়াও। কোথায় যাচ্ছ তুমি? উঠে এস। উঠে এস বললাম।
মবিন এখন পর্যন্ত কোনোদিন মিতুর হাত ধরে নি। তার খুব লজ্জা লাগে। এই প্রথম লজ্জা ভেঙে সে মিতুর হাত ধরল। আহ্ কী কোমল সেই হাত!