মিতু বসল। মোবারক সাহেব বললেন, আরাম করে বোস।
আমি আরাম করেই বসেছি।
তুমি গান জান?
জ্বি না।
ভালো টিচার রেখে গান শেখার ব্যবস্থা করে দেব। তোমার গলা ভালো। গান ভালোই গাইবে। তাছাড়া নাচ-গান এইসব ভালোমতো জানা তোমার নিজের স্বার্থেই দরকার। ছবির জগতের প্রধান নায়িকা নাচ-গান না জানলে চলে? আমি যে একটা ছবি বানাচ্ছি সেটা কি তুমি জান?
জ্বি শুনেছি।
সেই ছবির তুমিই প্রধান নায়িকা এটা শুনেছ?
আঁচ করতে পারছি।
তোমার ভালো লাগছে না?
চারদিকের বিপুল গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মিতু বলল, ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে।,
কোমল সেই হাত
প্রায় এক ঘণ্টার মতো হলো মবিন এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে। চিঠি যখন পড়েছে তখন ঘরে দিনের আলো ছিল। এখন অন্ধকার। মবিন আলো জ্বলে নি। অন্ধকার ঘরেই বসে আছে। তার চারদিকে পিনপিন করছে মশা। মশা তাড়াবার স্বাভাবিক ইচ্ছাটাও হচ্ছে না।
অবিশ্বাস্য এবং অকল্পনীয় একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। সিলেটের চা বাগানের এক ব্রিটিশ মালিক খোদ ইংল্যান্ড থেকে জানাচ্ছেন–তাকে লাক্কা টি গার্ডেনের ম্যানেজারের নিয়োগপত্র দেয়া হচ্ছে। এক বছরের ট্রেনিং পিরিয়ডের পর চাকরি স্থায়ী হবে। ট্রেনিং পর্ব দুভাগে বিভক্ত। প্রথম চার মাস ট্রেনিং হবে শ্ৰীলঙ্কার ‘ইয়ালো বিং টি গার্ডেন’। পরের আট মাস ইংল্যাণ্ডে।
ট্রেনিং পিরিয়ডের ভাতা উল্লেখ করা আছে। অঙ্কটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। পোশাক পরিচ্ছদ এবং প্যাসেজ মানির জন্যে চেস ম্যানহাটন ব্যাংকের ইসু্য করা একটি ব্যাংক ড্রাফট চিঠির সঙ্গে আছে। পাউন্ড স্টারলিঙে যে অঙ্ক সেখানে বসানো তা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
চা বাগানের চাকরির চেষ্টা সে করেছিল। ইন্টারভ্যু দিতে চিটাগাং পর্যন্ত গিয়েছিল। যাওয়া-আসার ভাড়া মিতু দিয়েছিল। সেই চাকুরি ছোট একটা চাকুরি। অন্য চা বাগান। এই যোগাযোগ কী করে হলো মবিন বুঝতে পারছে না। ইন্টারভ্যু বোর্ডের কেউ কি তার জন্যে সুপারিশ করেছেন? রহস্যটা কি?
মবিনের হতভম্ব ভাব কিছুতেই কাটছে না। চেস ম্যানহাটন ব্যাংকের ড্রাফটটা সঙ্গে না থাকলে ভাবত কেউ রসিকতা করছে। মানুষ নির্মম রসিকতা মাঝে মধ্যে করে।
এখন সে কী করবে? আনন্দ প্রকাশের জন্যে কিছু একটা করা উচিত। কাকে খবরটা প্রথম দেয়া যায়? মিতুকে তো বটেই। যদিও তার ইচ্ছা হচ্ছে একটা মাইক ভাড়া করে গাজীপুর শহরে রিকশায় ঘুরে ঘুরে খবরটা বলে বেড়ায়।
এ রকম একটা খবর মিতুকে খালি হাতে জানানো যাবে না। এক লাখ গোলাপ কিনতে পারলে এক লাখ গোলাপ নিয়ে মিতুর কাছে যাওয়া যেত। কত দাম এক লাখ গোলাপের?
মিতু খবরটা শুনে কী করবে? কী করবে। মবিন আন্দাজ করতে পারে। চট করে উঠে দাঁড়াবে, তারপর ছুটে সামনে থেকে চলে যাবে। কাঁদার জন্যে যাবে। মিতু তার সামনে কাঁদতে পারে না। অনেকক্ষণ পর সে ফিরে আসবে। খুব স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারবে না। মিতুর ধারণা অভিনেত্রী হিসেবে সে খুব বড়ো। আসলে বড়ো না। আসলে সে কাঁচা অভিনেত্রী। আবেগ লুকাতে পারে না।
না মিতুকে খবরটা এভাবে দেয়া যাবে না। মজা করে দিতে হবে। মুখ শুকনো করে তার কাছে যেতে হবে। বেশ রাত করে। মিতু উদ্বিগ্ন হয়ে বলবে, কী ব্যাপার এত রাতে? তখন সে বলবে, ঘরে কোনো খাবার আছে মিতু? সারাদিন খাই নি। হাত একেবারে খালি। লজ্জায় আসতেও পারছিলাম না। এটা শুনে মিতুর মুখ ছাইবৰ্ণ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে পানি এসে যাবে এবং সে দৌড়ে সামনে থেকে চলে যাবে। আধঘণ্টা পর এসে বলবে, এস খেতে এস। এমনভাবে বলবে যেন কিছুই হয় নি।
মা’কে একটা চিঠি লিখতে হবে। আজ রাতেই চিঠি লিখতে হবে।
মা,
আমার সালাম নিও।
তোমার চিঠি পেয়েছি। নানান ঝামেলায় ব্যস্ত ছিলাম বলে। উত্তর দিতে দেরি হলো। জোছনার ছেলে হয়েছে শুনে খুব খুশি হয়েছি। ওকে আমার অভিনন্দন দিও। বাবার চোখের খবর শুনে উদ্বিগ্ন বোধ করছি। আমার উচিত নিজে গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসা। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। চা বাগানের ম্যানেজারের একটি চাকরি পেয়েছি। প্রাথমিক ট্রেনিঙে আমাকে শ্ৰীলঙ্কা এবং পরে ইংল্যান্ডে যেতে হবে। ভিসা এবং অন্যান্য ব্যাপারে খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে। যাই হোক, আমি টাকা পাঠাচ্ছি। তুমি বাবাকে নিয়ে চলে এস, আমি এখানে ভালো একটা হোটেল ব্যবস্থা করে রাখব। তোমরা ঢাকায় আসার পর বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটির কাজগুলো মিতু করবে। মিতু হচ্ছে রফিকের বোন। ঐ যে একবার রফিককে নিয়ে এসেছিলাম। বাঁশি বাজিয়ে যে সবাইকে হতভম্ব করে দিয়েছিল।
মিতু খুবই চালাকচাতুর মেয়ে। সে তোমাদের কোনো অসুবিধাই হতে দেবে না। আমি যখন দেশের বাইরে থাকব। তখনো সে-ই তোমাদের দেখাশোনা এবং খোঁজখবর করবে।
তোমরা কবে নাগাদ আসবে। আমাকে টেলিগ্ৰাম করে জানিও। ভালো কথা, জোছনার ছেলের জন্যে সোনার চেইন, জোছনার জন্যে ভালো একটা শাড়ি কেনার জন্যে আলাদা করে টাকা পাঠালাম। তোমরা ভালো থেক। বাবাকে আমার সালাম দিও…
ঘর অন্ধকার করে বসে আছ কেন?
মবিন দারুণ চমকে উঠল। মিতু দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। মনে হয় অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। মবিন উঠল। বাতি জ্বালাল। অদ্ভুত গলায় বলল, ভেতরে এস মিতু।