মবিন তার ছাত্রীর বাসার বারান্দায় উঠে কলিংবেলে হাত রাখল। এই আরেক বিরক্তিকর ব্যাপার। এ বাড়িতে কলিংবেল টেপার অনেকক্ষণ পর একজন কেউ এসে দরজা খোলে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় অনন্তকাল পার করে দিচ্ছে।
আজ দেরি হলো না। কলিংবেল টেপামাত্র দরজা খুলে গেল। বুড্ডা মাথা বের করে বলল, আফা পড়ব না।
মবিনের ভুরু কুঞ্চিত হলো। গতকালও রোবট পড়তে আসে নি। কেন আসে নি। সেই কারণও দর্শানো হয় নি। রোবটমাতা শুধু বলেছেন–লাইলী আজ পড়বে না। তুমি রাত ন’টার দিকে এসে খেয়ে যেও। মবিন চলে এসেছে। রাত ন’টায় ভাত খাবার জন্যে যায় নি। খাওয়ার জন্যে আবার ফিরে যেতে লজ্জা লাগল। রাতে হোটেলে খেয়ে নিয়েছে। মানুষের অভ্যাস কত দ্রুত বদলায় কাল রাতে সে টের পেয়েছে। হোটেলের খাবার বলতে গেলে কিছুই খেতে পারে নি। যা খেয়েছে তাও হজম হয় নি–পেট নেমে গেছে।
বুড্ডা বলল, আফনেরে বলছে ভাত খাইয়া যাইতে।
তোমার আপা আজো পড়বে না?
জ্বে না।
পড়বে না কেন শরীর খারাপ?
জ্বে।
কী হয়েছে তার?
শইল খারাপ হইছে।
মবিন চলে আসছে। তার মন একটু খারাপ। হোটেলের ভয়ঙ্কর খাবার আজো খেতে হবে। পেট খারাপের ব্যাপারটা মনে হয় স্থায়ী হয়ে যাবে। মবিন গেট পর্যন্ত চলে এসেছে, বুড়া ছুটে এসে বলল, আম্মা আফনেরে ডাকে।
রোবটের মা অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিলেন না। মবিনকে আধঘণ্টার মতো বারান্দায় বসে থাকতে হলো। বুডা এসে এক সময় বলল, আফনেরে ভিতরে যাইতে বলছে। মবিন বুডার পেছনে পেছনে ঢুকল। রোবটমাতা বললেন, তুমি কাল খেতে আস নি কেন? লাইলী পড়ুন না পড়ুক তোমার দু’বেলা খাওয়ার কথা, তুমি খাবে।
ওর কী হয়েছে?
গায়ে গোটা গোটা উঠেছে, মনে হয় হাম।
আমি কয়েকদিন আসা বাদ দেব?
বাদ দাও। ও সুস্থ হলে আমি খবর পাঠাব।
জ্বি আচ্ছা। আজ তাহলে যাই? এখনি যাবে কেন? ভাত খাও। ভাত খেয়ে একবারে যাও। ভাত দিতে বলেছি। মবিনের খাওয়ার সময় ভদ্রমহিলা সামনে থাকেন না। আজ রইলেন। কাছে এলেন না–দূরে বসে রইলেন। মবিনের অস্বস্তি লাগছে। দীর্ঘদিন একা একা খেয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে। মহিলাদের কেউ আশপাশে থাকলে অস্বস্তি লাগে। ভদ্রমহিলা অবশ্যি দূরে বসে আছেন। সেটাও অস্বস্তিকর। মাতৃসম মহিলারা খাবার সময় এত দূরে থাকবেন কেন?
তোমার বাবা-মা কি বেঁচে আছেন?
জ্বি।
কোথায় থাকেন, দেশে?
জ্বি।
বাবা কিছু করেন? স্কুল টিচার ছিলেন। এখন গ্রামেই থাকেন। সামান্য জমিজমা আছে, না থাকার মতোই।
ভাইবোন ক’জন?
ভাই নেই, চার বোন।
বোনদের সব বিয়ে হয়ে গেছে?
দু’জনের হয়েছে।
ব্যক্তিগত সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার জন্যে রাগ করছ না তো?
জ্বি না। আমার কাজের ছেলেটা বলছিল তোমার ঘরে সুন্দরমতো একটা মেয়েকে দেখেছে।
মেয়েটা কে?
ওর নাম মিতু। ওর বড় ভাই আমার সঙ্গে পড়ত।
যে ভাই খুনের জন্যে জেল খাটছে?
মবিন বিরক্ত হলো–মহিলা সব জেনেশুনেই জিজ্ঞেস করছেন মেয়েটা কে? এতসব প্রশ্নের দরকারই বা কি?
সে দরিদ্র প্রাইভেট মাস্টার। পড়াতে এসেছে, পড়িয়ে চলে যাবে। ব্যাস।
ঐ মেয়ে কি তোমার কাছে প্রায়ই আসে?
জ্বি।
মেয়েটা কী করে।
সিনেমার ছোটখাটো রোল করে।
এতেই ওদের সংসার চলে?
চলে আর কোথায়? কোনোমতে জীবন ধারণ করা।
তিনজনের সংসার, বাড়ি ভাড়া, বোনের স্কুলের খরচ সব মেয়ের সামান্য রোজগারে চলে?
চালাতে হয়।
আমি মেয়েটার নামে অনেক আজেবাজে কথা শুনি। দামি দামি গাড়ি নাকি মাঝেমধ্যে নামিয়ে দিয়ে যায়।
মবিনের খাওয়া হয়ে গেছে। সে হাত ধোয়ার জন্যে উঠল। ভদ্রমহিলা নিজেও উঠে দাঁড়ালেন। উপদেশ দিচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, এ জাতীয় মেয়েদের সাথে সম্পর্ক না রাখাই ভালো।
মবিন কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়েও বলল না। কী হবে কঠিন কথা বলে?
আমি তাহলে যাই?
বোস। আরেকটু বোস। তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে। খুব জরুরি।
মবিন বিস্মিত হলো। তার সঙ্গে এই মহিলার কী জরুরি কথা থাকতে পারে? টেবিলের নিচে একবার তার রোবটকন্যার পায়ের সঙ্গে তার পা লেগে গিয়েছিল–এই খবরটা কি মেয়ে তার মা’কে জানিয়েছে?
এই ঘরে না, পাশের ঘরে আস। এই ঘরে লাইলীর বাবার কাছে বাইরের লোকজন আসে।
মবিন পাশের ঘরে গেল। এটা মনে হচ্ছে গেষ্টরুম। সুন্দর করে সাজানো। আলনা খালি দেখে মনে হয়। কেউ থাকে না। বোস, তুমি চেয়ারটায় বোস। মবিন অস্বস্তির সঙ্গে বসল। ভদ্রমহিলা দরজা ভিজিয়ে দিয়ে মবিনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। গলার স্বর নিচু করে বললেন, কাজের ছেলেটা যে দুপুরে তোমার জন্যে খাবার নিয়ে যায়–লাইলী কি ঐ ছেলের হাতে তোমাকে কোনো চিঠি পাঠিয়েছে?
মবিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। ভদ্রমহিলা বিষন্ন গলায় বললেন, সত্যি কথা বল। আমি খুব অশাস্তিতে আছি।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ও শুধু শুধু আমাকে চিঠি লিখবে কেন?
লেখে নাই তাহলে?
জ্বি না।
আচ্ছা তুমি যাও।
সমস্যাটা কী হয়েছে আপনি কি বলবেন?
না, সমস্যা কিছু না।
আমার কারণে কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে আমাকে বলে দিন।
বললাম তো কোনো সমস্যা হয় নি। আপনার যদি মনে হয় লাইলীকে পড়াতে না এলে ভালো হয়–তাহলে আমি কাল থেকে আসব না।
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আচ্ছা তাহলে তুমি বরং এস না।
জ্বি আচ্ছা।
আমি শুনেছি তুমি চাকরি খুঁজছ, পাচ্ছো না। আমি লাইলীর বাবাকে বলে দেব। যদি কিছু করতে পারে। ওর তো অনেক জানাশোনা।