জানি না কেন?
মবিন ভাইকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলাম—উনি উত্তর দিতে পারেন নি।
তাকে আবার কখন জিজ্ঞেস করেছিস?
ঐ দিন স্কুল থেকে টিফিন পিরিয়ডে পালিয়ে তাঁর কাছে চলে গেলাম। তাঁর ঘরে কী সুন্দর একটা শীতলপাটি পাতা! আমার সব সময় মনে হয়েছে তার ঘরটায় একা একা হাত-পা ছড়িয়ে শীতলপাটিতে ঘুমুতে পারলে খুব একটা আরামের ঘুম হবে। সেই জন্যে গিয়েছিলাম। তখন প্রশ্নটা করলাম।
মিতু তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ঘুমিয়েছিলি?
হুঁ। মবিন ভাই ঘরের ভেতরে আমাকে রেখে তালা দিয়ে ছাত্র পড়াতে চলে গেলেন। সন্ধ্যাবেলা এসে তালা খুললেন। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি। কী শান্তির ঘুম যে ঘুমিয়েছি!
ও আচ্ছা।
তুমি কি রাগ করলে আপা?
না।
কিন্তু তোমার গলার স্বর কেমন কঠিন হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তুমি রাগ করেছ।
পাশের ঘর থেকে শাহেদা ডাকলেন, মিতু, এই মিতু।
মিতু উঠে গেল। ঝুমুর আবার চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে ফেলল। চাদর দিয়ে শরীর ঢাকামাত্র আলাদা একটা জগৎ তৈরি হয়ে যায়। সেই জগতে কত কাণ্ড হয়। আধোঘুম জাগরণে ঝুমুর তার রহমস্যময় জগতে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
এখন সে হয়েছে দারুণ বড়োলোকের এক মেয়ে। ঘর থেকে সে পালিয়ে চলে এসেছে। তাকে খোঁজার জন্যে হুলস্থূল পড়ে গেছে। দু’লাখ টাকা পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজে পাওয়া যাবে কী করে, সে অতি সাধারণ একটা জায়গায় লুকিয়ে আছে। একটা দরজির দোকানে। দরজির দোকানের কর্মচারীর নাম শাহেদ। সে রাতে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে এক কোণায় রাজকন্যাদের মতো একটা মেয়ে লুকিয়ে আছে। সে ভয় পেয়ে বলল, কে?
ঝুমুর বলল, আমি নীলাঞ্জনা (রাজকন্যার নাম নীলাঞ্জনা চৌধুরী)
আপনি এখানে কেন? আমি কয়েকদিন লুকিয়ে থাকব। আপনি কি আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারবেন না?
আপনার মতো রূপবতী মেয়েকে আমি কোথায় লুকিয়ে রাখব?
লুকিয়ে রাখতে না চান না রাখবেন, শুধু আজ রাতটা থাকতে দিন, আমি ভোরবেলা চলে যাব।
রাতে কোথায় ঘুমুবেন?
কেন আপনার খাটে ঘুমুব। আপনি একদিকে তাকিয়ে ঘুমুবেন, আমি অন্যদিকে তাকিয়ে ঘুমুব। মাঝখানে একটা বালিশ দিয়ে রাখব যাতে গায়ের সঙ্গে গা লেগে না যায়।
আপনি তো ভয়ঙ্কর কথা বলছেন।
আমি মোটেই ভয়ঙ্কর কথা বলছি না। আমি সহজ স্বাভাবিক কথা বলছি।
ঝুমুর নীলাঞ্জনা চৌধুরীর ভূমিকায় অনেক রাত পর্যন্ত অভিনয় করল। তার ঘুম এল শেষ রাতে। তখন মোরগ, ডাকতে শুরু করেছে।
মাগরিবের নামযের পর
মাগরিবের নামযের পর মবিন তার ছাত্রীর বাড়িতে যায়। গরমের দিন বলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আযান পড়ে। সাতটা থেকে নটা–এই দুঘণ্টা একনাগাড়ে পড়ায়। মাঝখানে ইন্টারভ্যালের মতো হয়। ছাত্রী এবং ছাত্রীর মা দু’জন উঠে চলে যান। তখন তার জন্যে চা আসে–লেবু চা। চা খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র ছাত্রী এবং ছাত্রীর মা ঢোকেন। পড়াশোনা শুরু হয়। দেয়াল ঘড়িতে ন’টার ঘণ্টা পড়ামাত্র ছাত্রী প্ৰথমে ঘড়ির দিকে, তারপর তার মা’র দিকে তাকায় –এর অর্থ পড়া শেষ। দু’জন আবার উঠে চলে যায়।
মবিনের মাঝে মাঝে মনে হয় সে রোবটকে পড়াচ্ছে। যা বলছে লাইলী নামের রূপবতী রোবট তার মেমরি সেলে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। পড়ানোয় রোবটের লাভ কতটুকু হচ্ছে তাও ধরা যাচ্ছে না। এ ধরনের ছাত্রী পড়িয়ে আরাম নেই। তাছাড়া সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। কোনো কারণে রোবটের মর্যাদা বা সম্মান ক্ষুন্ন না হয় সেই ভয়।
একবার একটিভ ভয়েস পেসিভ ভয়েস পড়ানোর সময় মবিন একটু ঝুকে এসে–ছেটেবিলের নিচে তার পা লেগে গেল রোবটের সঙ্গে। রোবট ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল। মুখ তুলে তাকাল মবিনের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ঠোঁট কাঁপতে শুরু করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি প্ৰচণ্ড এক চিৎকার দেবে। মবিনের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রোবটের মা টেবিলের নিচে কী হয়েছে বুঝতে পারলেন না। তবে মেয়ের মুখভঙ্গি দেখে কিছু আঁচ করলেন। শঙ্কিত গলায় বললেন, কী হয়েছে রে?
লাইলী চোখ নামিয়ে বলল, কিছু না।
হাঁপ ছেড়ে মবিন আবার পড়াতে শুরু করল। একবার তার ইচ্ছে করল একটা কাগজে ইংরেজিতে লেখে Young lady, that was not intentional–দিকে বাড়িয়ে দেয়। সেই সাহসও হলো না। মেয়েটি যদি কী লেখা হয়েছে না পড়েই প্ৰেমপত্র লেখা হয়েছে মনে করে চিৎকার দিয়ে ওঠে। চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারলে মবিনের জন্য ভালো হতো। ছাড়া যাচ্ছে না। দুঘন্টা পরিশ্রমে সাত শ’ টাকা বেতন প্লাস দুবেলা খাওয়া ভাবা যায় না।
মবিনের ধারণা ছাত্রীর রোবট ভাব এবং ছাত্রীর মায়ের খবরদারি কিছুদিনের মধ্যেই কমে যাবে। যখন দু’জনই লক্ষ করবে এই মাস্টারের উদ্দেশ্য পড়ানো–টেবিলের পা দিয়ে পা চেপে ধরা না, প্রেমপত্র লেখা না।
মবিনের ধারণা মিলছে না–দু’মাস হলো সে পড়াচ্ছে, ছাত্রী এবং ছাত্রীর মা দু’মাস আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে। মবিনকে পড়ানোর সময় হাত-পা খুব সাবধানে রাখতে হয়। সারাক্ষণ মনে হয় সে একটা কচ্ছপ হলে মেয়েটিকে পড়ানো সহজ হতো। হাত-পা খোলসের ভেতর ঢুকিয়ে শুধু মাথাটা বের করে ছাত্রী পড়াত।
প্রকৃতি জীব জগতের নানান ‘ফরম’ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মানুষের জন্যে বর্তমান ফরম বেছে নিয়েছে। মানুষের জন্যে কচ্ছপ ফরমটাও খুব খারাপ ছিল না।