তুমি চিন্তা কোরো না মা। আমার মনে হয় না চিন্তার কিছু। তুমি ঘুমিয়ে থাক।
শাহেদা চুপ করে গেলেন। তাঁর চোখ বন্ধ। বন্ধ চোখের কোণা বেয়ে পানি পড়ছে। ঘরে আলো নেই বলে মিতু তা দেখতে পাচ্ছে না।
ঝুমুর চাদরে সারা শরীর ঢেকে শুয়ে আছে। মাথাও চাদরের নিচে ঢুকানো। আজ সে একা ঘুমুবে। মিতু ঘুমুবে মা’র সঙ্গে। ঘুমুতে যাবার আগে সে বোনের ঘরে ঢুকল। বিছানায় বসতে বসতে বলল, ঘুমুচ্ছিস নাকি ঝুমুর?
ঝুমুর জবাব দিল না। মিতু বলল, তুই জেগে আছিস আমি জানি। মুখ থেকে চাদর সরা।
ঝুমুর চাদর সরাল। মিতু বলল, ছেলেটা কে?
জানি না।
জানি না মানে? ওর নাম কি?
শহীদ।
তোর সঙ্গে কত দিনের পরিচয়?
আজই পরিচয় হয়েছে।
সে কী!
মবিন ভাইয়ের বাসার নিচে দরজির দোকানে কাজ করে। আমাকে তাদের ঘরে নিয়ে গেল। চা খাওয়াল।
আর তুই তাকে এরকম খাতির-যত্ন করে দিলি। না জানি সে কী ভাবছে?
ঝুমুর লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে সে বলল, পরশুদিন সকালে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে আপা।
পরশুদিন আসুক। তখন দেখা যাবে।
তুমি তো আজকের কাণ্ড দেখ নি–আজকের কান্ত দেখলে তোমার আক্কেলগুডুম হয়ে যেত।
তোর কাণ্ড দেখে আমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে।
ঝুমুর মাথা নিচু করে খুব হাসছে। হাসি দেখে মিতুর বড় মায়া লাগল। হঠাৎ সে বলল, আয় তো ঝুমুর তোকে একটু আদর করি। ঝুমুর চোখ তুলে তাকাল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আপাকে জড়িয়ে ধরল।
দু’বোন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে অনেক রাত পর্যন্ত কাঁদল। কেন কাঁদল তারা জানে না।
এক সময় ঝুমুর চোখ মুছে লজ্জিত ভঙ্গিতে ডাকল, আপা!
কি?
আমরা এত কান্নাকাটি করছি কেন?
আমি কী জন্যে কাঁদছি সেটা আমি জানি, তুই কী জন্যে কাঁদছিস সেটা তোর জানার কথা।
আমি জানি না।
না জেনেই ভেউ ভেউ করে কাঁদছিস?
হুঁ। আপা শোন–
বল শুনছি।
পরশু কী হবে বল তো—বাড়িওয়ালা চাচা যখন আসবে তখন তুমি যদি না থাক?
আমি না থাকলে তুই তো থাকবি। তুই সামলাবি।
আমি সামলাব? তুমি কি পাগল-টাগল হয়ে গেলে? কী সব কুৎসিত কথা যে লোকটা বলছিল!
বলুক না। এক সময় বলার কথা শেষ হয়ে যাবে।
লোকজন সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। কুৎসিত কুৎসিত কথা বলবে তখন আমি কী করব?
তুই ঘর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হবি। তাতেই কাজ হবে। কিছু মানুষের সিমপ্যাথি পেয়ে যাবি। যদি কাদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাস তাহলে আর দেখতে হবে না। সব লোক তোর পক্ষে চলে আসবে।
কী যে তোমার কথা। আপা!
মিতু হাসতে হাসতে বলল, ইচ্ছা করলে লোকটাকে আমরা কঠিন শাস্তিও দিতে পারি। কীভাবে জনিস?
কিভাবে?
খুব সহজ-কাঁদতে কাঁদতে ছোট্ট একটা অভিনয় করতে হবে। লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলতে হবে–যখন তখন আমাদের বাসায় আসত। কখনো পেঁপে নিয়ে আসত, কখনো কলা, কখনো আম নিয়ে আসত। একদিন খারাপ একটা ইঙ্গিত করে। আমরা তাকে ঘর থেকে বের করে দেই। তারপর থেকে সে আমাদের তাড়িয়ে দেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে।
কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।
করবে। মানুষের চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে যাই বলা হয় তাই সবাই বিশ্বাস করে।
তুমি বলতে পারবে এমন কথা?
না।
পরশুদিনের কথা ভেবে আমার এমন অস্থির লাগছে!
অস্থির লাগার কিছু নেই। পরশুদিন কেউ আসবে না। আমি ব্যবস্থা করব।
কী ব্যবস্থা করবে? সেটা তোর জানার দরকার নেই। তবে নিশ্চিত থাক। পরশুদিন কেউ আসবে না। কী ব্যবস্থা তুমি করবে। সেটা না জানলে আমি নিশ্চিত হতে পারব না। আমি ঘুমুতে পারব না।
আমার চেনা একজন মানুষ আছে। তাকে জানালেই আর কোনো সমস্যা হবে না।
উনি কি ভয়ঙ্কর কোনো মানুষ?
মোটেই না। আমুদে একজন মানুষ। কিন্তু তার ভয়ঙ্কর ক্ষমতা।
এরকম মানুষকে তুমি চেন কীভাবে? বেঁচে থাকার জন্যে অনেক” মানুষকে চিনতে হয়। অনেক কুৎসিত কাণ্ডকারখানা করতে হয়।
বেঁচে থাকাটা কি এতই জরুরি?
মিতু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, মাঝে মাঝে মনে হয় বেঁচে থাকা খুব জরুরি। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় মোটেই জরুরি না।
কখন তোমার কাছে মনে হয় বেঁচে থাকাটা জরুরি?
ঘুম পাচ্ছে–শুয়ে পড়।
না বল–কখন তোমার কাছে মনে হয় বেঁচে থাকাটা জরুরি?
মিতু নিচু গলায় বলল, মাঝে মাঝে শুটিং শেষ হবার পর–অনেক রাতে বাসায় ফিরি। পথে মনে হয় তুই আমার জন্যে বারান্দায় চুপচাপ বসে আছিস। পথে কোনো রিকশা দেখলেই চট করে উঠে দাঁড়াচ্ছিস, তখন বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি মনে হয়। মাঝে মাঝে শেষ রাতের দিকে হঠাৎ মনে হয় মা আমার কপালে হাত রেখে দেয়া পড়ছেন, তখন বেঁচে থাকাটা জরুরি মনে হয়। শুধু জরুরি না, অসম্ভব জরুরি মনে হয়।
তুমি আসল কথাটা কিন্তু আপা বল নি। আসল কথাটা এড়িয়ে গেছ।
আসল কথাটা কী?
আমরা কিছু না–মবিন ভাইয়ের কথা তোমার যখনই মনে হয় তখনি বেঁচে থাকাটা তোমার কাছে খুব জরুরি মনে হয়। ঠিক বলেছি না। আপা?
হয়তো ঠিক বলেছিস।
হয়তো না–আমি জানি এটাই আসল সত্য, বাকি সব নকল সত্য।
বয়সের তুলনায় তুই বেশি বেশি জেনে ফেলছিস। জানা ভালো, তবে বেশি জানা ভালো না।
ঝুমুর বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, খুব দুঃখী মানুষেরও বোধহয় বেঁচে থাকা জরুরি মনে হয় তাই না। আপা?
হয় বোধহয়। নয়তো তারা বেঁচে থাকে কেন?
সবাই তো আর বেঁচে থাকে না। কেউ কেউ আবার মরেও যায়। বিষ খায়। গলায় দড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে। কেন পড়ে?