ঝুমুর এসে ডাকল, মা মা। শাহেদা তাকালেন না। বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। মা তুমি বিছানায় এসে শোও।
ঝুমুর মা’র হাত ধরল। শাহেদার ইচ্ছা করল প্ৰচণ্ড ধাক্কা দিয়ে মেয়ের হাত সরিয়ে দেন। কিন্তু তিনি কোনো জোর পাচ্ছেন না। তাঁর শরীর পাখির পালকের মতো হালকা লাগছে। ঝুমুর হাত ধরে তাকে বিছানায় এনে শুইয়ে দিল। কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, মা তুমি এরকম করছি কেন? শাহেদা বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। তার হাত-পা ঘামছে। খুব তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। মেয়েকে পানি এনে দেবার কথা বলতে পারছেন না। জিভ ভারি হয়ে গেছে। প্ৰচণ্ড ঘুমাও পাচ্ছে। এই ঘুমাই কি শেষ ঘুম? মেয়েগুলোকে কয়েকটা কথা বলে যেতে চাচ্ছিলেন। বলা বোধহয় সম্ভব হবে না। চোখে আলো লাগছে। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
আবার যখন চোখ মেললেন তখন করুণ একটা মুখ তার মুখের উপর বুকে আছে। সেই মুখ গভীর মমতায় জানতে চাইল, কেমন আছ মা? চিনতে পারছ না। আমাকে? আমি মিতু।
শাহেদা ক্ষীণস্বরে বললেন, পানি খাব।
মিতু পানির গ্লাস নিয়ে এল। চামচ নিয়ে এল। সে চামচে করে মা’কে পানি খাওয়াতে যাচ্ছে কিন্তু তার হাত এত কাঁপছে যে চামচ থেকে ছলকে পানি পড়ে যাচ্ছে। মিতু কাঁদছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদছে। এত বেশি কাঁদছে যে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। শাহেদা বললেন, কাঁদিস না মা। তিনি মাথা ঘুরিয়ে ঝুমুরকে খুঁজলেন। মিতু বলল, ঝুমুরকে পাঠিয়েছি মবিন ভাইকে আনতে।
কয়টা বাজে?
রাত বেশি হয় নি মা, আটটা।
শাহেদা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন, কাঁদিস না।
মবিনের ঘরের সামনে ঝুমুর দাঁড়িয়ে আছে। ঘর বন্ধ, তালা ঝুলছে। নিচতলার দরজির দোকান খোলা। সেখান থেকে সেলাই মেশিনের খটখটি শব্দ আসছে। ভয়ে ঝুমুর অস্থির হয়ে গেছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। বৃষ্টি পড়ছে। সে দাঁড়িয়ে আছে দেয়াল ঘেঁসে। মাথার উপর ছাদের মতো একটু আছে বলে বৃষ্টিতে ভিজছে না। তাতে কি? কতক্ষণ সে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? সে যে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে তা দরজির দোকানের লোকটি দেখেছে। মেশিন বন্ধ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। ঝুমুরের মনে হচ্ছে সেই লোকটা উপরে উঠে আসবে। একা আসবে না, দু-একজন বন্ধুবান্ধব সঙ্গে নিয়ে আসবে।
ঝুমুর এখন কী করবে? বাসায় ফিরে যাবে? বাসায় ফিরে যাবার পথেও তো ঝুমুরকে তারা ধরে ফেলতে পারে। এমন অন্ধকার রাস্তা। তারা যদি রিকশা থামায়। রিকশা থামিয়ে ঝোপঝাড়ের দিকে নিয়ে যায়? চিৎকার করে উঠলে লাভ হবে না। এখনকার সময় এমন যে চিৎকার শুনলে কেউ আসে না। বরং দূরে সরে যায়।
বৃষ্টি জোরে নেমেছে। ঝুমুরের পা ভিজে যাচ্ছে। নিচের সেলাই মেশিনের খটখটি শব্দ এখন আর শোনা যাচ্ছে না। লোকটা নিশ্চয়ই সেলাই মেশিন বন্ধ করে উপরে উঠে আসছে।
ঝুমুরের গা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তার যে এত ভয়ঙ্কর বিপদ তা কেউ জানতে পারছে না। দরজির দোকানের লোকটা তাকে কোনো একটা খুপড়ি ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবে–তারপর সারারাত ধরে কুৎসিত কাণ্ডকারখানা করবে। ভোরারাতে গলা টিপে মেরে ফেলে রাখবে ধানক্ষেতে। এই ক্ষেত্রে এরকমই হয়।
বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস দিচ্ছে। ঝুমুর এখন পুরোপুরি ভিজে যাচ্ছে। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হচ্ছে। আসছে, দরজির দোকানের লোকটা আসছে। ভয়ঙ্কর কাণ্ডটা ঘটতে যাচ্ছে। সে এখন কী করবে? ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে যাবে? সাহস কি তার আছে? এমনও তো হতে পারে যে দরজির দোকানের লোকটা না মবিন ভাই-ই আসছেন। যদি মবিন ভাই হয় সে প্রথমে আনন্দে একটা চিৎকার দেবে এবং ছুটে গিয়ে মবিন ভাইকে জড়িয়ে ধরবে। এতে মবিন ভাই কিছু মনে করলেও তার কিছুই যায় আসে না।
না, মবিন ভাই না। দরজির দোকানের লোকটা। লম্বা কালো, রোগা একটা লোক। কী বিশ্ৰীভাবে সে তাকিয়ে আছে! ঝুমুর প্রায় দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেল। লোকটা বলল, মবিন সাহেবের খোঁজে আসছেন?
ঝুমুর কোনো উত্তর দিল না। তার শরীর শক্ত হয়ে গেছে।
বৃষ্টিতে ভিজতেছেন। নিচে বসেন। আসেন।
বদমায়েশ লোকটা তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জেনেও ঝুমুর যাচ্ছে। কারণ না গিয়ে সে কী করবে? কী হবে চিৎকার করে?
সাবধানে নামবেন, সিঁড়ি পিছল। ঝুমুর নিশ্চিত হলো সিঁড়ি পিছল এই অজুহাতে লোকটা তার হাত ধরবে। আচ্ছা! ঝুমুর কি পারে না প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে সিঁড়িতে ফেলে দিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে? তার জন্যে খুব বেশি সাহস কি লাগে? আচ্ছা আল্লাহ্ কিছু কিছু মানুষকে এত কম সাহস দিয়ে পাঠান কেন? তাকে যদি একটু বেশি সাহস দিয়ে পাঠাতেন। সামান্য বেশি, তাহলে তাঁর এমন কী ক্ষতি হতো?
ঝুমুর দোকানে ঢুকেছে। দোকানে লোকটা একা না। আট-দশ বছরের একটা ছেলেও আছে। সে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। লোকটা একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, বসেন।
ঝুমুর বসল। না বসে সে কী আর করবে। লোকটা এখন কী করবে ঝুমুর জানে। কোনো একটা অজুহাতে ছেলেটাকে বাইরে পাঠিয়ে দেবে। তারপর দরজা বন্ধ করে দেবে।
মবিন সাহেব বাসাতেই থাকে। আজ যেন কোথায় গেছে। এসে পড়বে।
ঝুমুরকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলা। পরিস্থিতি শুরুতে একটু স্বাভাবিক করা।
চা খাবেন? ঝুমুর হ্যাঁ না কিছু বলল না। লোকটা পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে বলল, ইসমাইল দৌড় দে।