মোবারক সাহেব বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলেন পাঁচ শ টাকার নোট চারটি চাদরের উপর পড়ে আছে। মেয়েটি কি ভুল করে ফেলে গেছে, না ইচ্ছা করে ফেলে গেছে। অতি তুচ্ছ যে মানুষ, তারও খানিকটা অহঙ্কার থাকে। সেই অহঙ্কারের কারণে টাকা রেখে যাওয়া? তা বোধহয় না। মেয়েটি শুধু যে টাকা ফেলে গেছে তাই না–চুলের ফিতাও ফেলে গেছে। মেয়েরা চুলের ফিতা, খোঁপার কাঁটা এইসব ব্যাপারে খুব সাবধানী হয়।
এই মেয়েটি সম্ভবত ভুলো মনের। সে হয়তো ভেবেছে তার হ্যাঁন্ডব্যাগে টাকাগুলো রেখেছে–আসলে রাখে নি।
তিনি ভূতের গল্পে মন দেবার চেষ্টা করলেন। এলিন নামের একটা মেয়ে একা একা তার অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে থাকে। সেভেন ইলিভেন শপে কাজ করে রাত দশটার দিকে ফেরে। শীতের রাত–ঘন কুয়াশা পড়েছে। ঘন কুয়াশার জন্যে এলিনের মনে হচ্ছে কে যেন তাকে ফলো করছে। সে যখন হাঁটে তখন পেছন থেকে জুতার শব্দ পাওয়া যায়। সে থেমে গেলেই জুতার শব্দ থেমে যায়। এলিন ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়াল। বলল, কে?
আমি।
যে আমি বলল তার গলার স্বর খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। অথচ এলিন সেই পরিচিত শব্দ চিনতে পারছে না। এলিন ভয়ে ভয়ে বলল, কুয়াশার জন্যে আমি তোমাকে পরিষ্কার দেখতে পারছি না। তুমি কি দয়া করে এগিয়ে আসবে?
খটখট জুতার শব্দ করে যে এগিয়ে এল সে দেখতে অবিকল এলিনের মতো। পোশাকও পরেছে এলিনের মতো। গলায় লাল স্কার্ফ। হাতে হলুদ দস্তানা। গায়ে ছাইরঙা ব্লেজার।
মোটামুটি জমাট গল্প। খুব জমাট গল্পে মোবারক সাহেবের ঘুম ধরে যায়। মস্তিষ্কের একটি অংশ গল্পটা পড়তে চায়। অন্য অংশ বলে–শুয়ে পড়। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে।
গল্পটা পড়ার জন্যে উৎসাহ যত বাড়ে, ঘুমাও ততই বাড়ে। আজ তা হচ্ছে না। আজ তিনি সূক্ষ্ম এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করছেন। যন্ত্রণাও ঠিক না–অস্বস্তি। মশারি খাটিয়ে ঘুমুতে যাবার পর কেউ যদি সেখানে ফুটো আবিষ্কার করে তখন যেমন অস্বস্তি লাগে, সে রকম অস্বস্তি। চোখে ঘুম না। আসা পর্যন্ত মনে হয় এই বুঝি ফুটো দিয়ে মশা ঢুকে গেল। তার অস্বস্তির কারণটা কী? মেয়েটা এই বিছানাতেই শুয়ে ছিল–চাদর বদলানো হয় নি। তার গায়ের গন্ধ চাদরে লেগে আছে–এই জন্যেই কি অস্বস্তি?
মোবারক সাহেব বিছানার চাদর বদলালেন। বালিশের ওয়ার বদলালেন। লাভ হলো না। রাত সাড়ে চারটা পর্যন্ত তিনি অঘুমো বসে রইলেন। অথচ তাঁর ঘুম দরকার। কাল সন্ধ্যায় তিনি জাপান যাবেন। তাঁর একটা জাহাজ টেরিফ আইন ভঙ্গের দায়ে জাপানে আটকা পড়েছে। জাহাজের স্কিপারের লাইসেন্সেও নাকি কী সমস্যা আছে। তাঁকে যেতে হবে। দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণের আগে আরাম করে ঘুমানোর প্রয়োজন ছিল।
তিনি ভূতের বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। মেডিসিন বক্স থেকে ঘুমের ওষুধ বের করে খাবেন। একটা হিপনল তার সঙ্গে দু’টা প্যারাসিটামল। ওষুধ খাবার পর গরম এক কাপ কফি খেলে ভালো হতো। কফি খেলে সবার ঘুম চটে যায়। তার উল্টোটা হয়–ঘুম পায়।
মোবারক সাহেব ওষুধ খেয়ে পাশের ঘরে গেলেন। ইন্টারকম তোলামাত্র ইদরিস বলল, স্যার স্নামালিকুম। মোবারক সাহেবের ধারণা তিনি যে ক’দিন এ বাড়িতে থাকেন। সে ক’দিন ইদরিস ঘুমায় না। ইন্টারকমের পাশে জেগে বসে থাকে।
ইদরিস।
জ্বি স্যার।
কড়া করে এক কাপ কফি খাওয়াও তো।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
ঐ মেয়েকে কি দিয়ে এসেছে?
অনেক আগেই গাড়ি চলে এসেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তিনি আবার শোবার ঘরে চলে এলেন। বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে গরম কফির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো–মেয়েটিকে তার সঙ্গে জাপানে নিয়ে গেলে কেমন হয়। মেয়েটির জন্যে সেটা একটা অকল্পনীয় ব্যাপার হবে না। সে হয়তো জীবনের প্রথম প্লেনে চড়বে, জীবনের প্রথম দেশের বাইরে যাবে। পদে পদে বিস্মিত হবে। তিনি খুব কাছ থেকে সেই বিস্ময় দেখবেন। বিস্মিত মানুষকে দেখতে ভালো লাগে। তার আশপাশে যারা থাকে তারা কেউ বিস্মিত হয় না। তিনি নিজেও বিস্মিত হওয়া ভুলে গেছেন।
একদিনে মেয়েটির পাসপোর্ট ও ভিসার ব্যবস্থা করা সমস্যা নয় বলেই তিনি মনে করেন। লোকমানকে খবর দিলেই সে ব্যবস্থা করবে। লোকমান পারে না এমন কাজ নেই। যে-কোনো কাজ দিয়ে তিনি যদি লোকমানকে বলেন–লোকমান, পারবে না? লোকমান তখন হতাশ তাকিয়ে থাকবে, মাথা চুলকাবে–ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলবে। তার ভাব দেখে মনে হবে সে গভীর সমুদ্রে পড়েছে কিন্তু বলবে সম্পূর্ণ উল্টো কথা। অস্পষ্ট গলায় প্ৰায় ফিসফিস করে বলবে–কেন পারব না?
এ ধরনের কথা বলার লোক দ্রুত কমে যাচ্ছে। কোনো কাজ দিলে বেশিরভাগ লোক বলে, স্যার চেষ্টা করে দেখব। সেই চেষ্টাটাও করে না।
দরজায় টোকা পড়ছে। গরম কফি নিয়ে ইদরিস চলে এসেছে। লোকমানের মতো এই আরেকজন। কুকুরের মতো অনুগত।
ইদরিস ভেতরে আস।
ইদরিস ঢুকুল। মোবারক সাহেবের দিকে চোখ তুলে তাকাল না। কখনো তাকায় না। টেবিলে কফির কাপ নামিয়ে রাখল। মোবারক সাহেব কাপ হাতে নিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে বললেন, কফি ভালো হয়েছে। শোন ইদরিস, আমি সকাল দশটা পৰ্যন্ত ঘুমুব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
লোকমানকে আমার একটু দরকার।
দশটার সময় আসতে বলব স্যার?
তিনি জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। ইদরিস বলল, এখন কি স্যার টেলিফোনে ধরে দেব? কথা বলবেন?