রেশমা বলল, আমি কি অন্য কারো জন্যে কিছু চাইতে পারি?
হ্যাঁ পার।
আমার একজন অতি প্রিয় মানুষ আছে। চা বাগানের একটা চাকরির তার খুব শখ। ভালো একটা চাকরি।
মোবারক সাহেব বললেন, আমার সঙ্গে আসি। আমি কম্পিউটারে তার নাম-ঠিকানা তুলে নিচ্ছি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা করব।
মোবারক সাহেব তাঁর কম্পিউটার থেকে The End লেখা মুছে ফেললেন। জরুরি লেখা ফোন্ডার ওপেন করে বললেন–
বল রেশমী, নাম বল।
রেশমা নাম বলল।
তুমি কি খেয়ে এসেছ?
জ্বি না।
আশ্চর্য! আমিও খাই নি। ইদরিসকে বলি খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। তুমি কী খেতে পছন্দ কর?
আমি সবকিছুই পছন্দ করি। আপনি কী পছন্দ করেন?
জানি না। আসলেই জানি না। মজার ব্যাপার কী জান মিতু অনেকদিন পর কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কী পছন্দ করি।—ঐ ভদ্রলোকের ঠিকানা কী বল? মেইলিং অ্যাড্রেস।
ঝুমুরদের রান্নাঘর বারান্দায়
ঝুমুরদের রান্নাঘর বারান্দায়। করোগেটেড টিন দিয়ে বারান্দার একটা অংশ আলাদা করে রান্নাঘর। চালে কয়েক জায়গায় ফুটো আছে। বৃষ্টির সময় ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। রাঁধতে শাহেদার খুব যন্ত্রণা হয়। শাহেদা এই মুহূর্তে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। বড়া ভাজার জন্যে তেল চড়িয়েছেন। বৃষ্টির পানি ফুটন্ত তেলে এসে পড়ছে। ফুটন্ত তেলের ছিটা তার মুখে এসে পড়েছে। মুখের খানিকটা তো অবশ্যই পুড়েছে। শাহেদাকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। তিনি আহু উহু জাতীয় কোনো শব্দ করেন নি। তাঁর ব্যস্ততা চুলাটা নিরাপদ কোনো জায়গায় সরিয়ে নেয়ার দিকে। এই সময় ঝুমুর এসে বলল, বাড়িওয়ালা এসেছে মা।
শাহেদা বললেন, কাল সকালে এসে বাড়ি ভাড়া নিয়ে যেতে বল।
বাড়ি ভাড়া নিতে আসেনি মা। বাড়ি ছেড়ে দেয়ার কথা। আমরা বাড়ি ছাড়ি নি এই নিয়ে খুব চোঁচামেচি করছে।
শাহেদা নির্বিকার গলায় বললেন, করতে থাকুক।
তিনি কেরোসিনের চুলা দেয়ালের দিকে সরিয়ে দিলেন। সেখানে পানি আরো বেশি পড়ছে। ঝুমুর বলল, মা তুমি আস উনি বিশ্ৰী বিশ্ৰী সব কথা বলছেন। বাড়ির সামনে লোক জমে গেছে।
শাহেদা চুলা থেকে কড়াই নামালেন। মাথার উপর আঁচল তুলে দিলেন। ঝুমুর মা’র সঙ্গে গেল না। তার হাত-পা কাঁপছে। তার মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ড হতে যাচ্ছে। এমন সময় হচ্ছে যখন আপা বাড়িতে নেই। আপা থাকলে যত ভয়ঙ্কর কাণ্ডই হোক সামাল দিতে পারত। এখন কে সামলাবে? এক ফাঁকে সে গিয়ে কি মবিন ভাইকে নিয়ে আসবে? মাঝে মাঝে একজন পুরুষ মানুষের উপস্থিতির এমন প্রয়োজন পড়ে!
শাহেদা বারান্দার খোলা দরজার পাশে দাঁড়ালেন। বাড়ির উঠানে এবং রাস্তায় এতগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে থাকবে তিনি কল্পনা করেন নি। হৈচৈ শুনে এরা জড়ো হয়েছে তাও মনে হচ্ছে না। বৃষ্টি মাথায় করে এতগুলো মানুষ জড়ো হবে না। নিজামউদ্দীন সাহেব মনে হচ্ছে এদের সঙ্গে করেই এনেছেন। ফুটন্ত তেল শাহেদার থুতনির কাছে পড়েছে। জায়গাটা কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি জমে ফোঁসকা উঠে যাবে। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। শাহেদা বললেন, কী হয়েছে?
নিজামউদ্দীনের গলা শীতল। কণ্ঠস্বরে কোনো রাগ নেই। তার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য পরিষ্কার। তিনি কথা বললেন উঁচু গলায় যাতে জড়ো হওয়া প্রতিটি মানুষ তার কথা শুনতে পায়।
কী হয়েছে আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেন? কী হয়েছে সেটা তো আপনি বলবেন। একত্রিশ তারিখ বাড়ি ছাড়ার কথা। আজ সাত তারিখ। বাড়ি ছাড়ার কোনো লক্ষণ নাই। বাড়ি ভাড়া দেয়ার সাড়াশব্দ নাই। ভাড়া আমার দরকার নাই। বাড়ি ছাড়েন।
শাহেদা শান্ত গলায় বললেন, ছাড়ব তো বটেই। বাড়ি খুঁজছি। পাওয়া গেলেই ছেড়ে দেব।
আমি খোঁজাখুঁজির কথা শুনতে চাই না। বাড়ি ছাড়বেন। আজ রাত্রেই ছাড়বেন।
আজ রাত্রেই ছাড়তে হবে?
অবশ্যই। ভদ্রপাড়ায় বাস করে দুই মেয়ে নিয়ে ব্যবসা করবেন সেটা আর হতে দেয়া যায় না।
আপনি কী বলছেন?
গলা বড় করবেন না। আমি বড় গলার ধার ধারি না। ভদ্রলোকের পাড়ায় বাস করে ব্যবসা করবেন আর আমরা চুপ করে থাকব? ঢাকা শহরে খারাপ পাড়ার তো অভাব নাই, সেখানে গিয়ে ওঠেন। ব্যবসাও ভালো হবে। উঠতি বয়সের দুই মেয়ে!
শাহেদা ভাঙা গলায় বললেন, চুপ করুন। আমি আপনার পায়ে ধরছি। চুপ করুন। আজ রাত্রেই আমি আপনার বাড়ি ছেড়ে দেব। আসুক, মেয়েটা আসুক।
নিজামউদ্দীন হৃষ্ট গলায় বললেন, মেয়ে ট্রিপ দিতে গেছে, এত সহজে কি আসবে? তার আসতে রাত দু’টা-তিনটা বাজবে।
ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বলল, চুপ করেন না ভাই, অনেক তো বললেন।
শাহেদা দরজা ধরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। বুকের ভেতর প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করে উঠলে ব্যথা কমবে।
নিজামউদ্দীন খড়খড়ে গলায় বললেন, আমি যা বলেছি। সত্য কথা বলেছি। যদি মিথ্যা বলি আমার উপর যেন আল্লাহর গজব পড়ে। তারপরেও বলতেছি–রাতটা থাকেন, পরের দিনটাও থাকেন। ব্যাস। পরশুদিন সকালে যেন দেখি বাড়ি পরিষ্কার। ভাড়া বাকি পড়েছে–দেয়া লাগবে না। মেয়ে খাটা পয়সার আমার দরকার নাই।
নিজামউদ্দীন নেমে যাচ্ছেন। যুদ্ধজয়ীর ভঙ্গিতে নামছেন। বৃষ্টির বেগও বাড়ছে। বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া লোকজন চলে যাচ্ছে। শাহেদা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বুকের যন্ত্রণাটা খুব বেড়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।