অসম্ভব। বসার ঘরের সোফা কেন, বারান্দায় শুয়ে থাকলেও সে ঝাঁটাপেটা করবে।
রেশমা বলল, ঠিক আছে থাকব না। ঘরে ঢুকতে দিন। ভয়ঙ্কর তৃষ্ণা হয়েছে। এক গ্লাস পানি খাব–তারপর ভেবে ঠিক করব কী করা যায়।
দিলদার খাঁ নিতান্ত অনিচ্ছায় দরজা থেকে সরে দাঁড়াল।
পুরনো অসুখটা কি আবার তাঁকে ধরেছে? সেই ভয়াবহ অসুখ? যে অসুখ গভীর গোপনে লুকিয়ে থাকে, হঠাৎ বের হয়। যখন বের হয় তখন সমগ্ৰ চিন্তা-চেতনা আচ্ছান্ন করে দেয়।
মোবারক সাহেবের চিন্তা-চেতনা গুলিয়ে যাচ্ছে। তিনি বসে আছেন তার এল সি থ্রি পারসোনাল কম্পিউটারের সামনে। পর্দায় দাবার বোর্ড। এবারের চাল তার দেয়ার কথা। পর্দায় ফ্ল্যাসিং সাইন উঠছে। সুন্দর চাল তাঁর আছে। মন্ত্রীর সামনের বড়ে এক ঘর এগিয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষের নাইটকে বেকায়দায় ফেলা। তিনি চাল দিচ্ছেন না। মূর্তির মতো বসে আছেন। তাঁর ভেতর থেকে একজন কেউ বলছে, অর্থহীন, এই চাল দেয়া অর্থহীন। কে বলছে? তাঁর পুরনো অসুখটা বলছে?
হ্যাঁ সেই পশুটাই বলছে। কিন্তু পশুটাকে এখন আর পশু বলে মনে হচ্ছে না। পশুর গলার স্বর মধুর। প্রথম যৌবনের কিশোরী প্রেমিকার কণ্ঠস্বরের মতো। তাঁর প্রথম যৌবনে কোনো কিশোরী প্ৰেমিকা ছিল না। থাকলে অবশ্যই সে এরকম কণ্ঠে কথা বলত।
কণ্ঠস্বর বলল, দাবার চাল দিয়ে কী হবে?
তিনি যুক্তি দিতে চেষ্টা করলেন। ক্ষীণস্বরে বললেন, আনন্দ। খেলার আনন্দ। জয়পরাজয়ের আনন্দ।
জয়-পরাজয়ের আনন্দ সবার জন্যে নয়। এই খেলায় জয় করেও তুমি আনন্দ পাবে না। পরাজিত হয়েও তুমি আনন্দ পাবে না। একটু শুধু ক্লান্ত হবে। তুমি ক্লান্ত হবার জন্যে খেলছ?
না।
তাহলে শুধু শুধু খেলছ কেন?
খেলছি না তো আমি বসে আছি।
এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবে?
জানি না।
অনন্তকাল বসে থাকবে?
অনন্তকাল বসে থাকব। কেন? আমি এখন উঠব। হাত-মুখ ধোব, কফি খাব, তারপর ঘুমুতে যাব।
কারো কারো জন্যে সময় থেমে যায়। তোমার জন্যে সময় থেমে গেছে। তুমি যাই কর তোমার কাছে মনে হবে তুমি অনন্তকাল ধরে করছি। সত্যি না?
হ্যাঁ সত্যি।
তুমি যখন তোমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বল— তোমার কাছে মনে হবে তুমি অনন্তকাল ধরে কথা বলছি। তুমি যখন হাতে কফির পেয়ালা নেবে তখন মনে হবে অনন্তকাল ধরেই কফির পেয়ালা হাতে তুমি বসে আছ।
আমি কি অভিশপ্ত?
সব মানুষই অভিশপ্ত। ওরা তা জানে না বলে ওরা হেসে খেলে জীবন ধারণ করছে। তুমি জেনে গেছ। তোমার মতো আরো অনেকেই জেনেছে। জাপানের নোবেল পুরস্কার পাওয়া সেই ঔপন্যাসিকের নাম যেন কি?
কাওয়াবাতা।
হ্যাঁ কাওয়াবাতা। তিনি যখন সব পেয়ে গেছেন তখন তিনি আত্মহত্যা করেন। এরকম উদাহরণ আরো আছে। আছে না?
আছে? কবি মায়াকোভস্কি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে… পুশকিনকেই বা বাদ দেবে কীভাবে?
পুশকিন ডুয়েলে মারা গেছেন।
একই কথা। ব্যাপার একই। জীবন তাদের কাছে অসহ্য বোধ হয়েছিল। তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই। তুমিও বুঝে গেছ…
আমার বিশাল কর্মকাণ্ড, ব্যবসা…
তাদের কর্মকাণ্ড কি তোমার চেয়ে কম ছিল?
মৃত্যু আমাকে কী দেবে?
কিছুই দেবে না। এটা কি অনেক বড় উপহার না?
সে রকমই মনে হচ্ছে।
একটা বইয়ের শেষ পাতায় কী লেখা থাকে–দি এন্ড। সমাপ্তি। মৃত্যু তোমাকে শেষ পাতায় এনে দেবে। এটা কি আনন্দময় একটা ব্যাপার না?
হ্যাঁ। আমাকে তুমি এখন কী করতে বল?
তুমি তোমার কম্পিউটারে লেখ–The End. সুন্দর করে লেখ। কম্পিউটারের পর্দায় তিনি লিখলেন
The End.
এত ছোট করে লিখেছ কেন? বড় টাইপে লেখা। সব ক্যাপিটেল লেটারে।
তিনি লিখলেন–
THE END.
আর তখন বিশ্ৰী শব্দে ইন্টারকম বাজতে লাগল। তিনি ইন্টারকমের রিসিভার কানে নিলেন। ইদরিস বলল, স্যার স্নামালিকুম।
তিনি যন্ত্রের মতো বললেন, কী ব্যাপার ইদরিস?
একটা মেয়ে এসেছে স্যার। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে।
কে এসেছে?
এই বাড়িতে সে আগে একবার এসেছিল।
টেপী?
নাম বলল রেশমা।
ও আচ্ছা।
ওকে কী বলব স্যার?
মোবারক সাহেব চুপ করে রইলেন। তার ভেতরে সেই পশু কিছু বলে কিনা শুনতে চেষ্টা করলেন। কেউ কিছু বলছে না। তিনি আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ইদরিস রেশমাকে উপরে নিয়ে এস।
জুি আচ্ছা স্যার।
রেশমা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ভয়ে ভয়ে উঠছে। সিঁড়ির মাথায় মোবারক সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। মোবারক সাহেবের মুখ হাসি হাসি।
তিনি দূর থেকে বললেন, কী ব্যাপার বল তো?
রেশমা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তাকে একটু যেন বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে। সে বলল, আমি আমার চুলের ফিতাটা ফেলে গিয়েছিলাম। নিতে এসেছি।
মোবারক সাহেবের মনে হলো, বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। সুন্দর জবাব দিয়েছে। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকলে মনের ভেতেরের পশুটাকে অনেকক্ষণের জন্যে আটকে রাখা যাবে।
তুমি কি ফিতা নিয়েই চলে যাবে?
আপনি থাকতে বললে থাকব।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, এস! এস! মোবারক সাহেব হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। রেশম ইতস্তত করছে। মোবারক সাহেব বললেন, ধর আমার হাত ধর।
রেশমা হাত ধরল। মোবারক সাহেব বললেন–তুমি হঠাৎ করে আসায় আমি যে কী ভয়ঙ্কর খুশি হয়েছি তুমি কোনোদিনও তা জানবে না। তুমি আমার কাছে কিছু চাও। যা চাইবে তাই পাবে। এটাকে মাহেন্দ্ৰক্ষণ হিসেবে ধরে নাও। বল কী চাও?