আজ শুক্রবারে। শুক্রবার তো শুটিং থাকে না।
আজ আছে।
ঐ দিন না বললি ছবির কাজ শেষ হয়ে গেছে?
প্যাঁচওয়ার্ক বাকি আছে। কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেগুলো আবার করা হবে।
রাতে ফিরবি না?
না।
শাহেদা মুখ শক্ত করে বসে আছেন। তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। চায়ের কাপে তিনি এখন আর চুমুক দিচ্ছেন না। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। মিতু শঙ্কিত গলায় বলল, কিছু বলছ মা?
শাহেদা ক্ষীণ স্বরে বললেন, তোর বাবাকে কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি। মুখটা খুব মলিন। তিনি বললেন–তুমি এত কষ্ট করছ, কেন? কষ্ট করার দরকার কি? এই টিনটা রাখ, এখানে ইঁদুর মারা বিষ আছে। তুমি নিজে খাও–মেয়ে দু’টাকে খাওয়াও, দেখবে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এই বলে তিনি একটা টিনের কৌটা আমার হাতে দিলেন।
রাতদিন এইসব ভাব এই জন্যেই স্বপ্নে দেখেছি।
তোর বাবা কথাটা কিন্তু ভুল বলে নি।
মিতু হাসছে। শাহেদা বললেন, হাসছিস কেন?
এমনি হাসছি। তুমি ঝাল ঝাল করে নলা মাছ রাঁধ তো মা। ইঁদুর মারা বিষ আবার মিশিয়ে দিও না। আমার এখন মরার কোনো রকম ইচ্ছা নেই।
শাহেদা নড়লেন না। বসেই রইলেন। মিতু বলল, এক কাজ করলে কেমন হয় মা, আজ আমি রান্না করি, রান্না করে তোমাকে খাওয়াই। তুমি চুপচাপ শুয়ে বিশ্ৰাম কর। আরেকটা কথা শোন, সংসারের সমস্যা নিয়ে তুমি মোটেও ভাববে না। আমি কী করব তোমাকে বলি, ঝুমুরকে বিয়ে দিয়ে দেব। ওর আর পড়াশোনা হবে না। ওর পড়াশোনায় মন নেই। মোটামুটি ধরনের একটা ছেলে দেখে ওর বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। ওর চেহারা ভালো–ছেলে পাওয়া কোনো সমস্যা হবে না। তোমাকে আমি বলি নি। এর মধ্যেই একটা সম্বন্ধ এসেছে। ছেলেটা ব্যাংকে চাকরি করে। ছোট চাকরি। তবে সংসারের দায়দায়িত্ব নেই। দু’জন মিলে ওরা সুখেই থাকবে। মবিন ভাই এর মধ্যে একটা চাকরি পেয়ে যাবে। তখন আমি বিয়ে করব। তুমি থাকবে আমার সংসারে। মাঝে মাঝে ঝুমুরকে গিয়ে দেখে আসবে। এখন তুমি আসি তো আমার সঙ্গে, রান্নার সময় যদি ভুল-টুল করি তুমি ধরিয়ে দেবে। আরেকটা কথা মা–এর পরে যদি কোনোদিন স্বপ্নে বাবাকে দেখ তোমার কাছে ইঁদুর মারা বিষ গছিয়ে দিতে চাচ্ছে তাহলে তুমি তাঁকে কিন্তু কঠিন ধমক দেবে।
মিতু বিছানা থেকে নামল। তার মাকে হাত ধরে তুলল। মিতুর মুখ হাসি হাসি।
শাহেদা বললেন, ঝুমুরকে বিয়ে করতে চাচ্ছে যে তার নাম কি?
আমানুল্লাহ্। অগ্ৰণী ব্যাংকে কাজ করে।
কী রকম কাজ? দারোয়ান টারোয়ান না তো?
না দারোয়ান না, ক্লার্ক।
তোকে সরাসরি বলেছে?
আমাকে বলে নি, মবিন ভাইকে বলেছে।
ওকে কেন বলবে? ও কে? তার কিছু বলার থাকলে সরাসরি তোকে কিংবা আমাকে বলবে। ছেলেটার দেশ কোথায়?
আমি মা কিছুই জানি না। আমি খোঁজ নিয়ে বলব।
কবে খোঁজ নিবি?
আজই খোঁজ নেব। এফডিসিতে যাবার আগে মবিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে তারপর যাব।
মবিন শুয়ে ছিল। মিতুকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসল। অবাক হয়ে বলল, আরো তুমি।
মিতু বলল, অবেলায় শুয়ে আছ কেন?
বেকার মানুষের আবার বেলা, অবেলা, কালবেলা? তুমি এই সময় যে?
এটা কি নিষিদ্ধ সময়?
না নিষিদ্ধ হবে কেন? এস ভেতরে এস? আমার চিরুনি এনেছ?
হুঁ।
সিগারেট?
না। সিগারেট আনা হয় নি।
কতক্ষণ থাকবে?
রাত আটটা পর্যন্ত থাকতে পারি। কিন্তু তোমার তো সময় হবে না।
সময় হবে না তোমাকে কে বলল?
সন্ধ্যাবেলায় তোমার টিউশানি আছে না?
ছিল–এখন নেই। সন্ধ্যাটায় আমি এখন স্বাধীন। গতকাল সন্ধ্যায় কী করেছি। জান, একটা সিনেমা দেখে ফেললাম, ‘জানি দুশমন’। আশায় আশায় গিয়েছিলাম, হয়তো তোমাকে দেখব। জানি দুশমন ছবিতে তুমি কাজ কর নি। তাই না?
না!
টেপী কি করেছে? সুন্দর মতো একটা এক্সট্রা মেয়ে দেখলাম। নায়িকার সঙ্গে নদীতে পানি আনতে গেল।
টেপী ঐ ছবিতে কাজ করেছে কিনা বলতে পারছি না।
দেখা হলে জিজ্ঞেস কোরো তো। ওর সঙ্গে এখন দেখা হয় না?
কম হয়।
ছবির ঐ মেয়েটাকে দেখে মনে হলো, এ নিশ্চয়ই টেপী। মেয়েটার মাথা ভর্তি চুল, জোড়া ভুরু।
জোড়া ভুরু! তাহলে টেপী না। টেপীর জোড়া ভুরু না।
মবিন আগ্রহের সঙ্গে বলল, টেপীর কথা আমার প্রায়ই মনে হয়। ওকে আমার দেখার খুব ইচ্ছা। একদিন তোমার সঙ্গে এফডিসিতে যাব। মেয়েটাকে দেখে আসব।
আচ্ছা।
ও আছে কেমন?
ভালোই আছে। দারুণ এক বড়োলোকের সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। সেদিন এফডিসি থেকে গাড়ি পাঠিয়ে তাকে নিয়ে গেল।
বল কী! সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
টেপী নিশ্চয়ই খুব খুশি।
না খুশি না। ও দেখলাম খুব ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠল। মুখটা কান্নাকান্না।
কেন বল তো?
বড়লোকেরা গাড়ি পাঠিয়ে তো আর গল্প করার জন্যে নিয়ে যায় না, প্রেম করার জন্যেও নিয়ে যায় না–অন্য কারণে নিয়ে যায়। সবাই সেটা জানে। কাজেই সবার চোখের উপর দিয়ে বিরাট এক গাড়িতে করে যাওয়া খুব লজ্জার ব্যাপার না?
অস্বস্তির ব্যাপার তো বটেই। দারুণ বড়লোকদের জন্যে দারুণ বড়লোক মেয়ে পাওয়া সমস্যা না–তারা পথেঘাটের মেয়েদের গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাবে কেন?
মিতু হাই তুলতে তুলতে বলল, পথের মেয়েদের সঙ্গে যত সহজ হওয়া যায় অন্যদের সঙ্গে তো তত সহজ হওয়া যায় না। পথের মেয়ের আলাদা আনন্দ আলাদা থ্রিল। যাই হোক টেপীকে নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। অন্য কিছু নিয়ে কথা বল।