হুঁ।
লুপ লাগানো হয়েছে। খণ্ড খণ্ড দৃশ্য বড় পদায় দেখানো হচ্ছে। ছবি দেখে দেখে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ডায়ালগ বলবেন, ম্যাগনেটিক ফিতায় সেই শব্দ ধরা হবে। পরে একসঙ্গে জোড়া লাগানো হবে।
বিমল বলল, ব্যাপারটা তো খুব ইন্টারেস্টিং।
কাগজে-কলমে খুব ইন্টারেস্টিং। তবে কাজ শুরু হলে দেখবে কত ঝামেলা। ঠোঁট মেলানো যায় না। ডায়ালগ যায় একদিকে ঠোঁট নড়ে অন্যদিকে।
কাজ শুরু হবে কখন?
ম্যাডাম এলেই শুরু হবে।
ফরহাদ সাহেব চায়ের কাপ এবং হাতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আজমল তরফদারের কাছে চলে এলেন।
কাজ শুরু হবে। কখন আজমল ভাই?
এই তো অল্প কিছুক্ষণ।
আপনার সঙ্গে বসে গল্পগুজব করি? নতুন বই নাকি করছেন? বিগ বাজেট মুভি।
হ্যাঁ।
স্টোরি লেখা হয়েছে?
হচ্ছে।
নায়ক-নায়িকা কয় পেয়ার? ওয়ান ওর টু?
এখনো কিছুই ঠিক হয় নি।
আর্টিস্টের ব্যাপারে কিছু ভাবছেন?
এখনো ভাবি নি।
আমার অবশ্য দম ফেলার সময় নেই। হেভি বুকিং। তারপরেও আপনার ব্যাপার অন্য।
থ্যাংক য়্যু।
আপনার ‘প্ৰেম দেওয়ানা’ও হিট করবে। ডায়ালগ মারাত্মক। হিট ডায়ালগ। ডায়ালগের জন্যে উঠে যাবে….
কথাবার্তার এই পর্যায়ে ডাবিং স্টুডিওর দরজা ফাঁক করে রেশমা তাকাল। আজমল তরফদার ফরহাদ সাহেবের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন, রেশমা এস এস।
রেশমা পুরোপুরি হকচাকিয়ে গেল। আজমল তরফদার এরকম অন্তরিক ভঙ্গিতে ডাকবেন ভাবাই যায় না। সে দেরি করে এসেছে বলেই কি রসিকতা করছেন? এখনই কুৎসিত গালি শুরু হবে? হলভর্তি মানুষের সামনে গালি শুনতে এত খারাপ লাগে। তার হাত-পা জমে যাবার মতো হলো।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, আস? পরিচয় করিয়ে দিই— এ হলো বিমল। বিমলচন্দ্র হাওলাদার। বিমল এর নাম রেশমা।
বিমল তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছে। বিনীতভাবে সে সালাম দিল। ফরহাদ পর্যন্ত অবাক হয়ে তাকাচ্ছে।
রেশমা ইতস্তত করে বলল, বাসের চাকা পাংচার হয়ে গিয়েছিল। ঠিক করল। এই জন্যে দেরি হয়েছে।
আজমল তরফদার বললেন, নো প্রবলেম। এগারটার আগে ডাবিং শুরু হবে না। তোমার বোধহয় দু’টা লুপ। এক সময় করে ফেললেই হবে। বিমল তোমাকে নিতে এসেছে। ওর সঙ্গে একটু যাও।
কোথায় যেতে হবে, কী ব্যাপার। এইসব কিছুই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। রেশমা’র মনে হলো সে পালিয়ে যেতে পারলে বাচে।
আজমল তরফদার বললেন, রেশমা তুমি কি চা খেয়ে যেতে চাও r চা হয়ে গেছে। এক কাপ চা খেয়ে যাও।
ডাইরেক্টর সাহেবের জন্যে আলাদা সুন্দর কাপে চা আসে। আজমল তরফদার নিজেই তার চায়ের কাপ এগিয়ে ধরলেন।
রেশমা ক্ষীণ গলায় বলল, চা খাব না।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি ফিরে এসে চা খেয়ো, এখন বরং বিমলের সঙ্গে চলে যাও।
ডাবিং স্টুডিওর সামনে কালো রঙের বিরাট একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির জানালার কাচে পর্দা দেয়া। বিমল এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। আশপাশের লোকজন কৌতুহলী চোখে তাকে দেখছে। তারচেয়েও বড় কথা আজমল তরফদার তাকে গাড়িতে তুলে দিতে এসেছেন।
মোবারক সাহেবের চোখে রিডিং গ্লাস। অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি চশমা। এই চশমার অসুবিধা এই যে, যার দিকে তাকানো হয়। সে চোখ দেখতে পায়। তিনি কাউকে তার চোখ দেখাতে চান না। তাঁর ধারণা শরীরের যেমন পোশাকের প্রয়োজন, চোখের তেমন পোশাক দরকার। নগ্ন চোখ নগ্ন শরীরের মতো।
মোবারক সাহেব বললেন, বোস, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
রেশমা বসল। জড়োসড়ো হয়ে বসল। মেয়েটিকে তিনি আগে একবারই দেখেছেন। সে দেখা রাতের দেখা। দিনে কখনো দেখেন নি। এখন ঝকঝকে দিন। ঘড়িতে বাজছে বারটা একুশ। রাতের দেখা মানুষ দিনের আলোয় সম্পূর্ণ অন্য রকম হয়ে যায়। এই মেয়েটার ক্ষেত্রে সে রকম ঘটে। কিনা তাঁর জানার ইচ্ছা।
মেয়েটি সাজগোজ করে নি। ঐ রাতে বেশ সেজেছিল। কপালে টিপ ছিল। ঠোঁটে লিপস্টিক ছিল। আজ কপাল শূন্য, ঠোঁটেও লিপষ্টিক নেই। মেয়েটি কোলের উপর হাত রেখে বসেছে বলে তিনি তার হাত দেখতে পাচ্ছেন না। ঐ রাতে মেয়েটির হাতে সবুজ রঙের কাচের চুড়ি ছিল। আজ বোধ হয় চুড়ি পরে নি। চুড়ি পরলে চুড়ির টুংটং আওয়াজ কানে আসত।
তোমার নাম টেপী তাই তো?
রেশমা জবাব দিল না। চুপ করে বসে রইল। মোবারক সাহেব চোখ থেকে রিডিং গ্রাস পুরোপুরি খুলে ফেললেন। তাঁর যে শুধু কাছে দেখার সমস্যা তাই না—মায়োপিয়া আছে বলে দূরের জিনিসও ভালো দেখতে পান না। মেয়েটিকে ভালোমতো দেখার জন্যে অন্য একটা চশমা দরকার। তিনি ড্রয়ার খুললেন। চশমা বের করে পরলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকলেন।
ঐ দিন তুমি মিথ্যা করে কেন বললে তোমার নাম টেপী, বোনের নাম হ্যাপী? মিথ্যা বলার প্রয়োজন ছিল কি?
ছিল।
আসল নাম, পরিচয় কাউকে জানতে দিতে চাও না, এই তো ব্যাপার?
জ্বি।
যে তোমার সত্যিকার পরিচয় বের করতে চায় তার জন্যে তো খুব সমস্যা হবার কথা না?
কেউ সত্যিকার পরিচয় বের করতে চায় না।
তুমি চা বা কফি খাবে?
জ্বি না।
তুমি সিনেমার লাইনে, সেখান থেকে নতুন পেশায় কীভাবে চলে এলে?
আমি বলতে চাচ্ছি না।
বলতে চাচ্ছ না কেন?
বলতে ইচ্ছা করছে না। গল্প করার মতো মজার কোনো বিষয় এটা না।
আমি তো গল্প করছি না। জানতে চাচ্ছি।
জানতে চাচ্ছেন কেন?
কৌতুহল বলতে পার। তোমার এক ভাই তো জেলে আছে। ও জেলে গেল কেন?