পুলিশ ভাইয়াকে ছাড়ল না। এই যে ভাইয়া গেল আর বাসায় ফিরল না। পরদিন ভোরবেলা আপা আমাকে নিয়ে থানায় গেছে। ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হলো হাজতে। ভাইয়া আপার দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই। বাসায় চলে যা। আমি একটা খুন করেছি। পুলিশের কাছে স্বীকার করেছি।
ঝুমুর।
ঝুমুর পেছন ফিরল। শাহেদা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখে বিস্ময় ও ভয়। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস?
ঝুমুর বলল, কারো সঙ্গে না। নিজের মনে কথা বলছি।
আয় ঘুমুতে আয়।
ঝুমুর বলল, আমি আরো কিছুক্ষণ বসে থাকব।
দুপুররাতে একা একা বারান্দায় বসে থাকবি এটা কেমন কথা? আমার বসে থাকতে ভালো লাগছে মা। আয় লক্ষ্মীসোনা, ঘরে আয়। শাহেদা বারান্দায় এসে ঝুমুরের হাত ধরলেন। ঝুমুর আপত্তি করল না, উঠে এলো। শাহেদা বললেন, রাতে তো কিছু খাস নি। খিদে হয়েছে, কিছু খাবি? একটা পরোটা ভেজে দেব?
দাও, তোমার শরীরটা এখন ভালো লাগছে মা?
শাহেদা জবাব দিলেন না। রান্নাঘরে ঢুকলেন। পরোটা বানানো গেল না। ময়দা শেষ হয়ে গেছে। তিনি ভুলে গেছেন। ময়দার কথা মিতুকে বলা হয়েছে–ভোরবেলা সে নিয়ে আসবে।
শাহেদা বললেন, চারটা চাল ফুটিয়ে দিই?
ঝুমুর বলল, কোনো কিছু ফুটিয়ে দিতে হবে না। তুমি ব্যস্ত হয়ে না। এক গ্লাস শরবত খেতে পারি। ঘরে কি চিনি আছে মা?
শাহেদা দেখলেন চিনির কোটাও খালি। ঝুমুর বলল, একেকটা দিন খুব অদ্ভুত হয়। কিছু পাওয়া যায় না। আবার কোনো কোনো দিন আছে–সব পাওয়া যায়। সেদিন তুমি যা চাইবে তাই পাবে।
শাহেদা শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমুর। মেয়েটাকে আজ অনেক বড় বড় লাগছে। ঝুমুর বলল, মা শোন, আপার একটা কথা তোমাকে বলি–আপাকে নিয়ে মাঝে মাঝে তুমি দুশ্চিন্তা কর। আজেবাজে কথা ভাব। এইসব ভাবার কোনো কারণ নেই। আপা মরে যাবে তবুও অন্যায় কিছু করবে না।
শাহেদার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝুমুর বলল, সিনেমার কাজ, শুটিঙের কাজ–রাত দিন বাইরে থাকতে হয় বলে লোকজন আজেবাজে কথা বলে। ওদের আজেবাজে কথা বলার কোনো কারণ নেই।
শাহেদা কাপা গলায় বললেন, সেইটাই তো আমি বলি মা। আমার নিজের মেয়ে আমি তাকে জানি না?
লোকজনের আজেবাজে কথা বলার কোনো অধিকারও নেই। আপা কি সামান্য চাকরির জন্যে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে যায় নি? কেউ কি দিয়েছে তাকে কিছু জোগাড় করে? আজি কোন বড় বড় কথা বলে?
শাহেদার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখ মুছলেন। চোখ মুছতে মুছতে বললেন–তুই যে বললি ও রাতে ঘুম থেকে উঠে কাঁদে। কাঁদে কেন?
মনের দুঃখে কাঁদে। আমার মনে হয় বেশিরভাগ সময় মবিন ভাইয়ের জন্যে কাঁদে। প্রায়ই তো মবিন ভাইয়ের টিউশ্যানি চলে যায়। বেচারার প্রায় না খেয়ে থাকার মতো জোগাড় হয়। একবার কী হয়েছে জান মা? প্ৰায় দশদিন মবিন ভাই ভাত খায় নি। যে হোটেলে বাকিতে খেত তারা খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে…
থাক এসব শুনতে চাচ্ছি না।
শোন না মা—মবিন ভাই বাধ্য হয়ে চিড়া আর গুড় কিনে আনল। চিড়া পানিতে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে খায়। আপা জানতে পেরে হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে এসে খুব কাঁদছিল।
শাহেদা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ঝুমুর এসে মায়ের পাশে বসল। কোমল গলায় বলল, তুমি মবিন ভাইয়ের সঙ্গে আপার বিয়ে দাও মা। ওরা কয়েকটা দিন আনন্দ করুক।
ও বউকে খাওয়াবে কী?
চিড়া আর গুড় খাওয়াবে। তাতে কী মা? ওরা দু’জন যখন বারান্দায় বসে গল্প করবে তখন দেখো তোমার কত ভালো লাগবে।
শাহেদা দেখলেন ঝুমুরের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
প্ৰেম দেওয়ানার ডাবিং
আজমল তরফদারের ছবি ‘প্ৰেম দেওয়ানা’র ডাবিং শুরু হয়েছে। ডাবিং স্টুডিওতে জমজমাট অবস্থা। ন’টা থেকে শিফট শুরু হলেও স্টার সুপারস্টাররা দশটা-এগারটার দিকে আসেন। যিনি যত বড়ো স্টার তিনি আসবেন তত দেরিতে। গ্যালাক্সি স্টার ফরহাদের সেই হিসেবে বারটার দিকে আসার কথা। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় তিনি সকাল ন’টার সময় চলে এসেছেন। তাঁর মুডও আজ খুব ভালো। গাড়ি থেকে নেমেই চেঁচিয়ে বললেন, আজমল ভাই জস্পেশ করে চা বানান দেখি। আপনার ব্যাটেলিয়ান রেডি?
হ্যাঁ রেডি।
দেখবেন ইনশাল্লাহু চল্লিশ লুপ এক শিফটে নামিয়ে দেব। ম্যাডাম এসেছেন?
এখনো আসেন নি।
ডায়ালগ দিতে বলুন। বসে বসে মুখস্থ করতে থাকি। চা তো এখনো দিল না।
ফরহাদ সাহেব ডাবিং রুমে ঢুকে গেলেন।
আজমল তরফদারের সঙ্গে বিমল দাঁড়িয়ে আছে। সে এসেছে বিশেষ কারণে, রেশমাকে বড় সাহেবের অফিসে নিয়ে যেতে হবে। বড় সাহেব খবর পাঠিয়েছেন। রেশমা’র আজ ডাবিং আছে। সে ন’টার আগেই এসে পড়ে। আজই শুধু দেরি হচ্ছে।
বিমল ফরহাদকে দেখিয়ে নিচু গলায় বলল, উনি কি আপনার ছবির হিরো?
হুঁ। যা তা হিরো না গ্যালাক্সি হিট হিরো।
আমাদের ছবিতে কি উনি থাকছেন?
হুঁ। না থাকলেই ভালো হত।
কেন?
গাধা। অভনয় জানে না।
তাহলে তাকে নিচ্ছেন কেন?
রিকশাওয়ালারা তাকে দেখতে চায়।
তাকে কি নতুন ছবির কথা বলা হয়েছে?
এখনো বলা হয় নি, তবে সে জেনে গেছে যে আমরা বড় বাজেটে নামছি। ছবি পাড়ায় খবর হয়ে গেছে। আজ যে ন’টার সময় উপস্থিত–এই কারণেই উপস্থিত।
আপনাকে খাতির করা শুরু করেছে?