এই বয়সে সিরিয়াস ব্যবসা তো পারব না। টাকা-পয়সা যা আছে তা দিয়ে একটা ফার্মেসি দেব। তার আয়ে সংসার চলবে। কেমন হবে বল তো?
ভালোই হবে।
ছেলেমেয়ের জন্যেই তো সংসার। সেই ছেলেমেয়েই যদি চোখের সামনে না থাকল তাহলে সংসার করে লাভ কী?
ঠিকই বলেছ।
এবার ফিরে গিয়েই চাকরি ছাড়ার ব্যবস্থা করব। যথেষ্ট হয়েছে। আর সহ্য হচ্ছে না।
চাকরি ছেড়ে দেবেন। এই সিদ্ধান্ত নেবার পর বাবা খুব খুশি। সবাইকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাবেন। মা-ও যাচ্ছেন। শুধু ভাইয়া যাবে না। জন্তু-জানোয়ার তার নাকি ভালো লাগে না। বাবা কত অনুরোধ করলেন। লাভ হলো না। শেষে মন খারাপ করে বাবা আমাদের নিয়েই গেলেন। বাঁদর দেখলেন, ময়ুর দেখলেন, হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পায়ে ব্যথা–বাবা নির্বিকার। বিকেলে চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে এসে বাবা বললেন, শাহেদা আমার শরীরটা যেন কেমন করছে।
মা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কেমন করছে মানে কী?
বুঝতে পারছি না। কী রকম যেন লাগছে–ভোম্বল সিং কোথায়?
ও গেছে বন্ধুদের বাসায়। ডাক্তার ডাকতে হবে?
বুঝতে পারছিনা। হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেল কিনা, সব কেমন যেন অন্ধকার লাগছে। ধোঁয়া ধোঁয়া।
এইসব কী বলছ?
ভোম্বল সিং কোথায়? ভোম্বল?
আপা ছুটে গেল। ডাক্তার ডাকতে। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম, মা কাঁদতে লাগল। বাবা শুধু একটু পর পর বলতে লাগল–ভোম্বল কোথায়? ভোম্বল সিং?
ঠিক দু’ঘণ্টার ভেতর বাবা মারা গেলেন। আমরা হাসপাতালে নেবারও সময় পেলাম না। ভাইয়া বাসায় ফিরাল সন্ধ্যার পর। বাসায় তখন অনেক লোকজন। ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, ব্যাপার কী? কী হয়েছে?
তারপর?
তারপর আবার কী? কিছু না।
তোমার ভাইয়া বাবার মৃত্যু কীভাবে গ্রহণ করল?
জানি না। কীভাবে গ্রহণ করল। সে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ফিরে এল তিনদিন পর। বাবার এর মধ্যে কবর হয়ে গেছে। ঘরে লোকজনের ভিড় নেই। মা’র হার্টের অসুখের মতো হয়েছে–বিছানায় শোয়া। ডাক্তার তাঁকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। ঘুমের ওষুধ খায়–ঘুমুতে পারে না–ঝিম মেরে পড়ে থাকে।
ভাইয়া ফিরে এসে সংসারে হাল ধরল। তার তখন কত বয়স? বি এ ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। চাকরি বাকরির অনেক চেষ্টা করল, পেল না। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ড দিয়ে ব্যবসার চেষ্টা করল। হেন ব্যবসা নেই যা সে করে নি। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পরিশ্রম। মানুষ যে কী অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারে আপনি ভাইয়াকে সেই সময় না দেখলে বিশ্বাস করবেন না, এক সময় খবর পেল এফডিসিতে মালামাল সাপ্লাইয়ের ভালো ব্যবসা আছে। ইনভেস্টমেন্ট কম, লাভ বেশি। শুরু করল সেই ব্যবসা।
লাভ হলো?
মোটামুটি হলো। ভাইয়ার ভাগ্য ছিল খারাপ। খারাপ ভাগ্যের মানুষ তো খুব ভালো কিছু করতে পারে না।
উনি মানুষ খুন করলেন কেন?
সেটা আমি আপনাকে বলব না। সব কথা বলতে নেই। কিছু কিছু কথা না বলাই ভালো। হয়েছে কী জানেন? ভাইয়া তো গভীর রাতে ফেরে, সেদিন হঠাৎ দুপুরে এসে হাজির। আমাকে বলল, খুকি চিড়িয়াখানায় যাবি? ভাইয়া আমাকে ঝুমুর ডাকত না, ডাকত খুকি। ভাইয়া আমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতে চায় শুনে আমি অবাক হলাম না। কারণ আমি জানতাম বাবার মৃত্যুর পর ভাইয়া প্রায়ই চিড়িয়াখানায় যায়। বানরের খাচার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি বললাম, হ্যাঁ ভাইয়া যাব। আমি কাপড় পরে তৈরি হয়েছি। ভাইয়া বলল–না থাক। তখন আমরা মগবাজারের একটা বাসায় থাকতাম। ছোট একতলা বাসার একদিকে আমরা অন্যদিকে হাফিজ সাহেব বলে এক ভদ্রলোক আর তার স্ত্রী, দুই ছেলে। সেদিন ভাইয়া সেই যে দুপুরে এসেছে আর বেরুচ্ছে না। সন্ধ্যাবেলায় মা বললেন–কী-রে তোর কি শরীরটা খারাপ?
ভাইয়া বলল, হঁ।
জ্বর-টর নাকি রে দেখি কাছে আয় তো।
ভাইয়া বলল, দেখতে হবে না। জ্বর টর কিছু হয় নি। রাতে ভাইয়া ভাত খেল না। ন’টার সময় ঘুমিয়ে পড়ল। সে বাইরের ঘরে ঘুমাল। আমি গিয়ে দেখি মশা ভিনভন করছে–এর মধ্যেই ভাইয়া ঘুমাচ্ছে। আমি মশারি খাটিয়ে দিলাম। ভাইয়া রাত বারটার দিকে জেগে উঠল। নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের কেতলি বসাল। খটখট শব্দ শুনে মা জেগেছে। রান্নাঘরে ঢুকে অবাক হয়ে বলল, তুই এখানে কী করছিস, ভাইয়া হাসিমুখে বলল, চা বানাচ্ছি। তুমি খাবে মা? মা বলল, না। ভাইয়া বলল, খাও না। দেখ আমি কী সুন্দর চা বানাই! ভাইয়া চা বানোল। মা’কে নিয়ে দু’জনে মিলে চা খেল। তার কিছুক্ষণ পর দরজার কলিংবেল বাজতে লাগল। মা বললেন, কে? পাশের ঘরের হাফিজ সাহেব বললেন, খালাম্মা দরজা খুলুন। পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।
মা হতভম্ব হয়ে দরজা খুললেন। আমি তখন জেগেছি, আপা জেগেছে। আমরা বুঝতেই পারছি না। কী হচ্ছে। আমরা দেখলাম, অনেকগুলো পুলিশ বাড়িতে ঢুকাল। ওরা বিছানা, বালিশ, খাট, মিটসেফ ওলট-পালট করতে লাগল। আপা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ভাইয়া কী ব্যাপার? ভাইয়া জবাব দিল না। একজন পুলিশ অফিসার বললেন, ভয়ের কিছু নেই। রুটিন চেক। আমরা এক্ষুণি চলে যাব।
তারা কিছুক্ষণের মধ্যে চলে গেল, তবে যাবার সময় ভাইয়াকে নিয়ে গেল। আপা বললেন, ভাইয়াকে কোথায় নিচ্ছেন? পুলিশ অফিসার বললেন, থানায় দুএকটা প্রশ্নট্ৰিশ্ন জিজ্ঞেস করে ছেড়ে দেব। আজ রাতেই ছেড়ে দেব। ভয়ের কিছু নেই।