মোবারক সাহেব লেখার টেবিলে বসলেন। টেবিলের উপর পেজ মার্ক লাগানো একটা বই–স্টিভেন ওয়াইনবার্গের–“The First 3 minutes”. প্রথম চ্যাপ্টারে পেজ মার্ক দেয়া। প্রথম চ্যাপ্টারের নাম–The Giant and the Cow. দৈত্য ও গরু। চ্যাপ্টারের শিরোনাম হিসেবে সুন্দর। তিনি পেজ মার্ক দিয়েছেন, পড়তে শুরু করেন নি।
টেবিলের উপর ইন্টারকমে ছোট্ট লালবাতি জ্বলছে। ইন্টারকমের বোতাম টেপামাত্র একতলা থেকে ইদরিস বলবে, স্যার স্নালামিকুম।
এখন রাত বেশি না–এগারটা চল্লিশ। রাত তিনটায় বোতাম টিপলেও সঙ্গে সঙ্গে ইদরিসের সাড়া পাওয়া যাবে।
তিনি ইন্টারকমের বোতাম টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইদরিস বলল, স্যার স্নামালিকুম।
ইদরিস তুমি মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়ে এস।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
আজ আমার সাইড টেবিলে অ্যাশট্রে ছিল না কেন ইদরিস?
ইদরিস জবাব দিল না। তিনি বুঝতে পারছেন ইদরিসের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমছে।
কেউ কি টেলিফোন করেছিল?
আন্মা টেলিফোন করেছিলেন। আমি বলেছি আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ঠিক আছে।
আম্মা বলেছেন খুব জরুরি।
মোবারক সাহেব ইন্টারকম নামিয়ে রাখতেই দরজা ধরে মেয়েটি দাঁড়াল। মেয়েটিকে এখন কেমন অসহায় লাগছে। সে ক্ষীণ গলায় বলল, আমি যাই?
আচ্ছা।
আপনি আমার উপর রাগ করেছেন কেন আমি বুঝলাম না।
রাগ করি নি। আমি আরেকদিন তোমার নাচ দেখব।
বের হব কোন দিক দিয়ে?
দরজা খুলে হলঘরে চলে যাও। সেখান থেকে নিচে নামার সিঁড়ি আছে। নিচে নামলেই দেখবে ইদরিস তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
জ্বি আচ্ছা!
এত বড় বাড়ি কিন্তু কোনো শব্দ নেই। সুনসান নীরবতা। মোবারক সাহেব কাঠের সিঁড়ি বেয়ে মেয়েটির নেমে যাওয়ার শব্দ শুনলেন। কলাপসিবল গেট খোলার শব্দ শুনলেন। গাড়ি স্ট্যার্ট দিয়ে বের হবার শব্দ শুনলেন। তখন তাঁর মনে হলো, মেয়েটিকে রেখে দিলে পারতেন। টুকটাক করে সুন্দর কথা বলছিল। মাঝে মাঝে অতি তুচ্ছ কথা শুনতেও ভালো লাগে। তিনি আবারো কলিংবেলে হাত রাখলেন, ইদরিস বলল, স্যার স্নামালিকুম। ইদরিস তাহলে মেয়েটির সঙ্গে যায় নি। ড্রাইভারের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইদরিস তাকে একা রেখে যাবে না। এটা ধরে নেয়া যায়।
ইসরিস!
জ্বি স্যার।
বাসার সঙ্গে টেলিফোন কানেকশন করে দাও, রেহানার সঙ্গে কথা বলব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তিনি টেলিফোন ধরার জন্যে লবিতে চলে এলেন। তার শোবার ঘরে কোনো টেলিফোন নেই।
কে রেহানা?
হ্যাঁ। ওমা একটু আগে ইদরিস বলল তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ।
ভুল বলেছে। আমি জেগেই ছিলাম। বাতি নিভিয়ে শুয়ে ছিলাম, ইদরিস ভেবেছে ঘুমিয়ে পড়েছি। তুমি টেলিফোন করেছিলে কেন?
নাজু অ্যাকসিডেন্ট করেছে।
নাজুটা কে মোবারক সাহেব চিনতে পারলেন না। তাঁর শ্বশুরবাড়ির দিকের কেউ হবে। রেহানার দশ হাজার আত্মীয় আছে ঢাকা শহরে। তাদের সবাইকে চেনা সম্ভব নয়। চেনার কোনো প্রয়োজনও নেই।
ভয়াবহ অ্যাকসিডেন্ট। কী হয়েছে শোন…
মোবারক সাহেব দীর্ঘ গল্প শোনার জন্যে মানসিক প্ৰস্তৃতি নিয়ে নিলেন। রেহানা অল্প কথায় কিছুই বলতে পারে না। ‘সামারি এন্ড সাবসটেন্স’ বলে তার কিছু নেই। সে ছোট্ট একটা গল্পকে রবারের মতো টেনে লম্বা করবে। মূল গল্প বলতে বলতে শাখা গল্পে চলে যাবে। সেখান থেকে যাবে প্ৰশাখায়…৷ এক সময় কোনটা আসল গল্প কোনটা প্রশাখা কিছুই বোঝা যাবে না।
নাজু নিউ এলিফ্যান্ট রোডে মোজা কিনতে গিয়েছিল। বাটা সিগন্যালের কাছে যে দোকানগুলো ছিল সেখান থেকে মোজা কিনে গাড়িতে উঠেছে। আজ আবার তার ড্রাইভার আসে নি। নিজেই গাড়ি চালাচ্ছে। স্টার্ট নেবার সময় হঠাৎ অ্যাক্সিলেটরে পা দিয়ে ফেলেছে–সামনে এক লোক গ্যাস বেলুন বিক্রি করছিল, ওকে হিট করল…
মোবারক সাহেব ওয়াইনবার্গের বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন। পড়তে শুরু করবেন। কিনা বুঝতে পারছেন না। অ্যাকসিডেন্টের গল্প দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলার কথা। ক্লান্তিহীন কথা একজন মানুষ কী করে বলতে পারে? মোবারক সাহেব টেলিফোনের কথা শোনায় আবার মন দিলেন–মাঝখানে তিনি বোধহয় কিছু মিস করেছেন, এখন হচ্ছে জন্মদিনের কেকের কথা। অ্যাকসিডেন্ট থেকে জন্মদিনের কেকের গল্প কীভাবে চলে এল কে জানে।
সোনারগাঁয়ে গিয়েছে কেকের জন্যে–ওরা বলল, দু’কেজির কম হলে কালই দিতে পারবে। এক শ মানুষের জন্যে দু’কেজি কেক–এ কি হবে? আধা চামচ করেও তো হবে না। তুমিই বল, জন্মদিনে এক শ মানুষ হবে না?
কার জন্মদিনে এক শ মানুষ হবে মোবারক সাহেব কিছুই জানেন না। তারপরেও বললেন, আমার ধারণা এক শ’র বেশি হবে।
এই তো তুমি বললে এক শ’র বেশি হবে। আমিও তাই বলছি। রুনীর ধারণা কেউ আসবে না…
মোবারক সাহেব কথার মাঝখানে কথা বলার মতো অভদ্রতা শেষ পর্যন্ত করলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, রেহানা শোন, আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। আমি বরং শুয়ে পড়ি।
কখন মাথা ধরল?
সন্ধ্যা থেকেই।
সে কি! কেনো ডাক্তার ডাক নি।
সামান্য মাথাধরা। তার জন্য আবার ডাক্তার।
মাথাধরা কখনো সমান্য ভাববে না। অনেক মেজর ডিজিজের ফাস্ট ওয়ার্নিং হচ্ছে মাথাধরা। মাথাধরাকে সিরিয়াসলি নিতে হবে।
আচ্ছা এখন থেকে সিরিয়াসলি নেব। রেহানা রাখি?
রেহানা কিছু বলার আগেই তিনি টেলিফোন রেখে দিলেন। ঘুম আসছে কিনা। তিনি বুঝতে পারছেন না। ক্লান্তি লাগছে। ক্লান্তি এবং ঘুম পাওয়া এক জিনিস নয়। রাত জেগে খানিকক্ষণ ভূতের গল্প পড়া যেতে পারে। ঘুম আনার জন্যে ভূতের গল্প খুব কাজে আসে।