না। আপার স্বভাব হলো চুপচাপ থাকা। বকবক যা করার আমিই করি। আপা শুধু শুনে যায়। আপা পুরুষ মানুষ হলে খুব ভালো স্বামী হত।
শাহেদা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। ঝুমুর বিরক্ত গলায় বলল, তুমি এভাবে তাকিয়ো না–তোমাকে আমাদের জিওগ্রাফি আপার মতো লাগছে।
শাহেদা চাপা গলায় বললেন, তোর আপার সঙ্গে রাতে যখন ঘুমাস সে কিছুই বলে না?
ঘুমের মধ্যে কথা বলবে কীভাবে! আপা ক্লান্ত হয়ে থাকে, মরার মতো ঘুমায়। মাঝে মাঝে…
মাঝে মাঝে কী?
মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে। দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদে।
তুই তখন কী করিস?
কিছুই করি না। ভান করি যেন মরার মতো ঘুমুচ্ছি।
ও কেন কাঁদে।
আমি কী করে জানিব কেন কাঁদে? সে যেমন রাতে মাঝে মাঝে কাদে, তুমিও কাঁদ। তুমি কেন কাঁদ সেটা যেমন আমি জানি না, আপা কেন কাঁদে সেটাও জানি না–জানতে ইচ্ছাও করে না।
শাহেদ ক্লান্ত গলায় বললেন, সেই ইচ্ছা করবে কেন? সংসারের কোনো কিছু নিয়ে তো তোকে ভাবতে হচ্ছে না। দিব্যি খাচ্ছিস, ঘুমুচ্ছিস–গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরছিস।
তুমি আমার উপর শুধু শুধু রাগ করছ। রাগ করার মতো যখন কিছু করব তখন রাগ কোরো। তোমাকে বেশি দিন অপেক্ষাও করতে হবে না। রাগ করার মতো কিছু খুব শিগগিরই করব।
সেটা কী?
টেস্ট পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে গোল্লা খাব।
শাহেদা কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। ঝুমুর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, মা তোমাকে একটা কথা বলি মন দিয়ে শোন–আপা কী করে সংসার চালাচ্ছে সেটা তুমি খুব ভালো করেই জান। তুমি ভান করছ, তুমি কিছু জান না। আমিও ভান করছি আমি কিছু জানি না। এটা কি মা ঠিক হচ্ছে?
শাহেদা তাকিয়ে আছেন। পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছেন। তার হাত-পা থারথার করে কঁপিছে। ঝুমুর উঠে দাঁড়াল। শান্ত ভঙ্গিতে ঘরের বাতি নিভিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। সেখান থেকে চলে গেল বারান্দায়। বারান্দায় দেয়াল ঘেসে মোড়া পাতা। দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝুমুর বসেছে।
বাইরে সুন্দর জোছনা। খানিকটা জোছনা বারান্দায় এসে পড়েছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জোছনা নেমেছে। বারান্দায় সুন্দর পাতার নকশা। বাতাসে পাতা কাঁপছে–জোছনার নকশাও কাঁপছে। ঝুমুর সেই অপূর্ব নকশার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে।
ভেতর থেকে শাহেদা ডাকলেন, ঝুমুর, ঝুমুর।
ঝুমুর জবাব দিল না। সে চোখের পানি মুছে খালি চেয়ারটা নিজের পাশে টেনে আনল। তার কাছে এখন মনে হচ্ছে –খালি চেয়ারে তার স্বামী বসে আছে। সে তাঁর পায়ের কাছাকাছি বসেছে। ঝুমুর বলল, ঘুমাবে না?
সে বলল, না।
ঘুমাবে না কেন? রাত তিনটা বাজে।
তুমি বডড বিরক্ত কর ঝুমুর। দেখছ না জোছনা দেখছি।
তুমি কি কবি যে তোমাকে হাঁ করে জোছনা দেখতে হবে?
হ্যাঁ আমি কবি।
কবিরা জোছনা দেখে না। তারা তাদের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কে বলেছে তোমাকে?
আমি জানি। এখন তুমি আমার দিকে তাকাও।
উফ! তুমি কী যে বিরক্ত কর!
আমার দিকে না তাকালে আমি আরো বিরক্ত করব।
সে ঝুমুরের দিকে তাকাল। তাকিয়েই হেসে ফেলল। এত সুন্দর করে সে হাসল যে হাসি দেখে ঝুমুরের চোখে পানি এসে গেল।
ভেতর থেকে শাহেদা আবারো ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, ঝুমুর।
ঝুমুর কঠিন স্বরে বলল, ডাকাডাকি করবে না মা, আমি আসব না।
না, ঝুমুর যাবে না। সে বারান্দায় বসে থাকবে–সারারাত বসে থাকবে। পাশে বসে থাকা মানুষটার সঙ্গে কথা বলবে। ওকে একা রেখে সে যেতে পারবে না। পাশে বসা মানুষটা বলল, পানি খাব ঝুমুর।
ঝুমুর বলল, না তুমি পানি খাবে না। পানি খাবার কথা বলে তুমি আমাকে ভেতরে পাঠাতে চাচ্ছ। ভেতরে গেলেই মা’র কাছে যেতে হবে। মা’র কাছে গেলে আমি আর আসতে পারব না। তোমার সঙ্গে গল্প করাও হবে না।
মা’কে তুমি ভালোবাস না?
না, আমি কাউকেই ভালোবাসি না।
আমার ধারণা তুমি রাগ করে এ রকম কথা বলছি–আসলে তুমি সবাইকে ভালোবাস।
তোমার ধারণা নিয়ে তুমি বসে থাক।
কী ব্যাপার, তুমি দেখি আমার উপরও রাগ করছ।
আমি সবার উপরই রাগ করছি।
কিছুক্ষণের জন্যে কি রাগ বন্ধ করা যায়?
যায়।
বেশ, রাগটা খানিকক্ষণের জন্যে ধামাচাপা দাও। ধামাচাপা দিয়ে আমার হাত ধরে বস। গল্প কর।
কী গল্প?
যে-কোনো গল্প। তোমার বাবার গল্প বল।
বাবার কোনো গল্প নেই। ভালোমানুষ ছিলেন–হঠাৎ একদিন মরে গেলেন। ব্যাস।
তোমাদের ভালোবাসতেন না?
বাসতেন?
খুব ভালোবাসতেন, না মোটামুটি?
ভাইয়াকে খুব ভালোবাসতেন। ভাইয়াকে ডাকতেন ভোম্বল সিং। ছোটবেলায় গোব্দা গোদা ছিল তো–ভোম্বল সিং নাম দিয়েছিলেন–বড় হয়েও সেই নাম। ভাইয়া কত রাগ করেছে, কান্নাকাটি করেছে, লাভ হয় নি। বাবা ভোম্বল সিং ডাকবেই।
তোমার ভাইয়া বাবাকে কেমন ভালোবাসত?
ভাইয়া ভালোবাসত টাসত না, বাবাকে এড়িয়ে চলত। বাবার খুব চিড়িয়াখানা দেখার শখ। আমরা ঢাকায় থাকতাম, উনি থাকতেন সিলেটের জঙ্গলে।। যতবার ঢাকায় আসতেন ঘ্যান ঘ্যান করতেন–ভোম্বল সিং, চল যাই চিড়িয়াখানা দেখে আসি। ভাইয়া যাবে না। কত সাধাসাদি। শেষটায় মন খারাপ করে আমাকে নিয়ে যেতেন। বাবা ঢাকা এসেছেন অথচ চিড়িয়াখানায় যান নি–এরকম কখনো হয় নি। বাবা কীভাবে মারা গোল সেটা শুনবেন?
বল।
গরমের সময় হঠাৎ ছুটি নিয়ে ঢাকা চলে এলেন। মা’কে বললেন, একা একা থাকতে অসহ্য লাগে। তোমরা এক জায়গায়-আমি অন্য জায়গায়। উপায়ও নেই, জঙ্গলের মধ্যে তোমাদের আমি কোথায় রাখব? বাচ্চাদের পড়াশোনা। মন মানে না বলে ছুটি নিয়ে চলে আসি। ভাবছি টাকা-পয়সা প্রভিডেন্ট ফান্ডে যা আছে তাই নিয়ে ব্যবসা করব। মা বলল, তাই কর। চাকরি যথেষ্ট হয়েছে।