না না বলুন কী কথা শুনেছেন?
এই যে ধরুন মিতু ছবিতে কাজ করে। এইসব কাজের ধরন-ধারণ তো আলাদা। রাত-বিরাত পার করতে হয়। এমনও হয়েছে–দুদিন-তিনদিন মেয়ের খোঁজ নাই। যে কাজের যে দস্তুর। সাধারণ মানুষ তো এইসব বুঝে না। অকথা-কুকথা বলে।
শাহেদা কাঁপা গলায় বললেন, আমার মেয়েকে নিয়ে কুকথা বলে? আমার মেয়েকে নিয়ে–যে মেয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্যে দিনরাত খেটে মরছে সেই মেয়েকে নিয়ে কুকথা বলে?
এই তো আপা আপনি মনটা খারাপ করলেন। মন খারাপ করার কিছু নাই। দুনিয়ার এই হলো হাল। মানুষের মুখ তো আপনি বন্ধ করতে পারবেন না। এই পৃথিবীতে সবচে’ খারাপ জায়গা হলো পায়খানা। মানুষের মুখ সেই পায়খানার চেয়েও খারাপ। পায়খানার দরজা বন্ধ করা যায়, তালা দেওয়া যায়–মানুষের মুখ বন্ধ করা যায় না।
শাহেদা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আমি আপনার বাড়ি ছেড়ে দেব। এক তারিখের আগেই ছাড়ব। আমার মেয়ের কারণে আপনাকে কথা শুনতে হচ্ছে এটা যদি আগে জানাতেন আগেই ছেড়ে দিতাম।
নিজামউদ্দীন খুশি খুশি গলায় বললেন, তুচ্ছ ব্যাপার আপনার কানে তুলব কেন? আমার একটা বিবেচনা আছে না। আমার তো চোখ আছে। আমি দেখছি না–একটা বাচ্চা মেয়ে সংসার টানছে? বড় ভাই মানুষ খুন করে জেলে বসে আছে। লোকে কী বলে না বলে সেটা শুনলে দুনিয়া চলত না। শোনেন একটা ঘটনা বলি। ঘটনাটা না শুনলে বুঝতে পারবেন না।
থাক ঘটনা শুনতে হবে না।
আপা শোনেন। শোনার দরকার আছে–গত জুম্মাবারে জুম্মা পড়ে বাসায় ফিরছি। ইসলাম সাহেব পথে আমাকে ধরলেন। ইসলাম সাহেব আমার ভাড়াটে-অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজার। আমাকে বললেন…
আমার শরীরটা ভালো না। কিছু শুনতে ভালো লাগছে না।
থাক তাহলে। মানুষের কানকথা যত কম শোনা যায় ততই ভালো, শুনলেই বিপদ। আপা তাহলে উঠি?
জ্বি আচ্ছা।
তাহলে এই কথা রইল— মাসের এক তারিখ ইনশাল্লাহ্ ঘর খালি করে দিচ্ছেন।
বললাম তো দিব।
আলহামদুলিল্লাহ। সত্যি কথা বলতে কি আপা একশ একটা পাপ করার পর লোকে ভাড়াটে হয়। টু লেট সাইন ঝুলালে ভাড়াটে পাবেন না। যখন ভাড়াটে তুলতে যাবেন এরা উঠবে না। যেন তাদের বাপের বাড়ি…
শাহেদা বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন, রাতের রান্না কিছু হয় নি। ঝুমুরকে বলেছেন একার জন্যে চারটা চাল ফুটিয়ে ডিম ভেজে খেযে নিতে। ঝুমুর এখনো চুলা ধরায় নি। শাহেদা ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, ঝুমুর।
ঝুমুর দরজা ধরে দাঁড়াল।
তোর নিজের জন্যে দু’টা ভাত রেঁধে ফেল, আমি খাব না।
আমিও খাব না।
রাতে না খেয়ে থাকবি?
হুঁ।
করা যা ইচ্ছা। তোর আপা কি বলেছে–রাতে ফিরবে না?
না, সারারাত শুটিং চলবে। তোমার কি মাথায় যন্ত্রণা?
হুঁ।
মাথা টিপে দেব?
কিছু করতে হবে না। তুই ঘরের বাতি নিভিয়ে চলে যা।
মশারি খাটিয়ে দেব? মশা আছে তো।
যেতে বললাম না!
ঝুমুর মা’র ঘর থেকে চলে এলো। তার টেস্ট পরীক্ষা শুরু হচ্ছে ন’তারিখ থেকে। বই নিয়ে বসতে ইচ্ছা করছে না। এমনিতে সে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে পারে কিন্তু বই নিয়ে বসলেই শুধু হাই ওঠে।
ঝুমুর খাটের উপর পা তুলে বসল। বই নিয়ে বসবে কি বসবে না ঠিক করতে পারল না। কারো সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে— গল্প করার মানুষ নেই। কথা শুনতে ভালবাসে এমন কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে সে বেঁচে যায়। সমস্ত পুরুষদেরকে ঝুমুর তিন ভাগে ভাগ করেছে–
এক, এরা কথা শুনতে ভালোবাসে। স্বামী হিসেবে এরা আদর্শ।
দুই, এরা কথা বলতে ভালোবাসে। স্বামী হিসেবে এরা মোটামুটি।
তিন, এরা কথা শুনতেও ভালবাসে না, বলতেও ভালোবাসে না। স্বামী হিসেবে এরা ভয়াবহ।
মবিন ভাই কোন শ্রেণীর ঐ প্রথম শ্রেণীর? পুরোপুরি না। তিনি কথা শোনার চেয়ে বলতে বেশি পছন্দ করেন। স্বামী হিসেবে মবিন ভাইকে আদর্শ বলা যাবে না। উনার বেশি বুদ্ধি। স্বামীদের কম বুদ্ধি থাকা ভালো। বেশি বুদ্ধির মানুষরা নানান ধরনের চালাকি করে।
ঝুমুর।
জ্বি।
এক গ্ৰাস পানি দিয়ে যা।
ঝুমুর উঠে গিয়ে পানির গ্লাস ভর্তি করে পানি নিয়ে গেল। বাতি জ্বালাল।
শাহেদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, বাতি নেভা। বাতি জ্বেলেছিস কেন?
অন্ধকারে পানি খাবে কীভাবে?
ঝুমুর লক্ষ করল পানির গ্লাস হাতে নিতে গিয়ে শাহেদার হাত কাঁপতে লাগল। ঝুমুর বলল, মা তোমার কি জ্বর বেড়েছে?
জানি না। বাতি নিভিয়ে চলে যা।
তুমি আমার সঙ্গে অকারণে এত রাগারগি করছ কেন? বাড়িওয়ালা চাচার কথা শুনে তুমি রেগেছ–সেই রাগ ঝাড়ছ আমার উপর। মানুষ কত কথা বলবে–তাই শুনে রেগে যেতে হবে?
কুৎসিত কথা শুনব তার পরেও রাগিব না?
কুৎসিত কথা তো আমি সারাক্ষণই শুনি–আমি কি রাগ করি? রাগ করি না। আমি থাকি আমার মতো।
তুই সারাক্ষণ কুৎসিত কথা শুনিস?
হ্যাঁ।
কে বলে?
স্কুলের মেয়েরা বলে। সেদিন জিওগ্রাফি আপা আমাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন…
কী জিজ্ঞেস করলেন?
হেনতেন নানান কথা, সংসার চলে কী করে? বড় বোন কী করে। এইসব জাবিজাবি।
কই আমাকে তো কোনোদিন কিছু বলিস নি।
তোমাকে শুধু শুধু বলব কেন? তাছাড়া আমি একজনের কথা আরেকজনকে বলি না।
ঝুমুর, তুই আমার কাছে এসে বোস।
কেন?
বসতে বলছি বোস।
তুমি এমনভাবে বলছি যে মনে হচ্ছে তুমি আমাকে মারবে।
মারব না, কাছে আয়। বোস এখানে–তোর আপার সঙ্গে তুই তো গুটিগুটি করে অনেক কথা বলিস। সে কি কখনো তোকে গোপন কিছু বলেছে?