দাও।
আজমল তরফদারের জন্যে নতুন করে কফি আনতে গিয়েছে, কিন্তু তিনি মনের ভুলে ঠাণ্ডা, সরপড়া কফিতেই চুমুক দিয়ে ফেলেন।
বিমল।
জ্বি স্যার?
তোমাদের এই বড় সাহেবের, আই মিন মোবারক সাহেবের ছবি বানানোর শখের পেছনের কারণটা কী?
ব্যবসা। ছবির ব্যবসা তো ভালো ব্যবসা। বাংলাদেশে পাঁচ শ’র মতো সিনেমা হল-প্রতি হল থেকে গড়পড়তা দশ হাজার টাকা পেলেও প্রথম রানে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা উঠে আসে। তাছাড়া আমি যতদূর জানি উনি সিনেমা হলও বানাবেন।
সিনেমা হল বানাবেন?
জায়গা নেয়া হয়েছে, আর্কিটেক্টকে ডিজাইন করতে বলা হয়েছে।
বল কী?
স্যার, উনি খুব গোছানো মানুষ।
তাই তো দেখছি। আমার ধারণা ছিল ছবি তৈরির ব্যাপারটা হুট করে মাথায় এসেছে।
নতুন কফি এসেছে। পিরিচে বেনসন এন্ড হেজেস-এর প্যাকেট এবং দেশলাই। আজমল তরফদার বললেন, বিমল তুমি সিগারেট খাও?
জ্বি স্যার, খাই।
নাও সিগারেট নাও।
আপনার সামনে খাব না স্যার।
খাও খাও, ফিল্ম লাইনে সব সমান।
বিমল সিগারেট ধরাল না। আজমল তরফদাব সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে কফিতে চুমুক দিলেন। বিমল বলল, স্যার যারা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে তারা শুধু যে ভাগ্যের জোরে সেটা করে তা কিন্তু না। ভাগ্য থাকে তাদের হাতের মুঠোয়, ভাগ্য নিয়ে তারা খেলা করে। পৃথিবীতে যারা বিলিওনিয়ার আছে তারা কোনো কারণ ছাড়াই বিলিওনিয়ার হয় নি।
তুমি কী বলতে চোচ্ছ বুঝতে পারছি না।
আমি বলতে চাচ্ছি—বড় সাহেব হুট করে কোনোদিনই কিছু করেন না। তিনি যখন ছবির জগতে এসেছেন তখন ধরে নিতে হবে এই জগৎ তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন।
আজমল তরফদার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আমি বিলিয়নিয়ার না, সামান্য ফিল্ম মেকার–আইএ পাস বিদ্যা। আমি তোমাকে একটা কথা বলছি, শুনে রাখ। ছবি বানানোর এই ঝোঁক তোমার বড় সাহেবের হঠাৎ করেই হয়েছে। আমাদের ছবি পাড়ার একটা মেয়ে–আজেবাজে টাইপের মেয়ের জন্যে এটা তার গিফট। তবে ঝানু ব্যবসায়ীরা গিফট থেকেও লাভ করে। যে কারণে এত আটঘাট বেঁধে ছবিতে নামা হচ্ছে। রেশমা নামের বলতে গেলে পথের-কুকুরি সুপারস্টার হিসেবে বের হয়ে আসবে। সে তার পুরস্কার পেয়ে গেল। একই সঙ্গে ছবির বাণিজ্যও হলো।
বিমল চুপ করে আছে। কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। আজমল তরফদার বললেন, বিমল তোমাকে আমার মনে ধরেছে বলে আমি এই কথাগুলো বললাম।
বিমল বলল, স্যার আপনাকেও আমার মনে ধরেছে। ছবি বানানোর ব্যাপারে আমাদের টিমওয়ার্ক খুব কাজে আসবে। আপনি গাড়ি রিকুইজিশন না করেই উঠে যাচ্ছেন। কী গাড়ি নেবেন তা তো বলেন নি। আরেকটু বসুন–কাজটা শেষ করি। আপনি কিন্তু দ্বিতীয়বারের কফিটাও খান নি–ঠাণ্ডা করে ফেলেছেন।
বাড়িওয়ালা চাচা নিজামউদ্দীন
ঝুমুর দরজা খুলে দেখে বাড়িওয়ালা চাচা নিজামউদ্দীন। আজো তার হাতে দু’টো পাকা পেঁপে। তার আগের বার দিয়ে যাওয়া পেঁপে দু’টোর একটা এখনো পড়ে আছে। ফেলে দেয়াই উচিত। মিষ্টি-টিষ্টি কিচ্ছু নেই–তিতকুট স্বাদ। এত বড় একটা পাকা পেঁপে ফেলতে মায়া লাগে বলে ফেলা হয় নি।
নিজামউদ্দীন হাসিমুখে বললেন, কেমন আছ গো মা?
ঝুমুর বলল, ভালো।
আপা আছে?
জ্বি না।
ফিরবে না?
আজ রাতে ফিরবে না।
ছবির শুটিং কি সারারাত ধরেই চলে?
সব সময় চলে না, মাঝে মাঝে চলে–যখন ছবির কাজ দ্রুত শেষ করতে হয় তখন সারারাত কাজ করতে হয়।
হতে পারে। ছবির লাইনের কাজকারবার তো জানি না। তোমার আপার সঙ্গে দরকার ছিল। যাই হোক মা আছে না?
আছে। উনার শরীর ভালো না–শুয়ে আছে।
আমার কথা একটু গিয়ে বল। দু’টা কথা বলে চলে যাব। নাও পেঁপে দু’টা নিয়ে যাও।
আপনি বসুন।
নিজামউদ্দীন বসতে বসতে বললেন, ঘরে পান থাকলে আমাকে একটু পান দিও তো মা। রাতে ভাত খেয়েই বের হয়েছি।–মুখ মিষ্টি হয়ে আছে।
ঘরে পান নেই, মা পান খায় না।
তাহলে থাক। কিছু লাগবে না।
শাহেদা চাদর গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এলেন। নিজামউদ্দীন মধুর গলায় বললেন, আপার শরীরটা নাকি খারাপ?
না তেমন কিছু না। সামান্য গা গরম।
সামান্য বলে অবহেলা করবেন না। আপনার আমার যা বয়স–এই বয়সে সামান্য বলে কোনো কিছুকেই অবহেলা করতে নেই। নিজের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যাই হোক আপ–মেয়ের সঙ্গে কি কথা বলেছিলেন? ঐ যে বাড়ির বিষয়ে–বাড়িটা যে আমার লাগে।
এখানো বলি নি।
একটু যে তাড়াতাড়ি করতে হয় আপা। মাস শেষ হতে তো বাকি নেই।
ভাই সাহেব। আমাদের তো সময় দিতে হবে। বললেই তো বাসা পাওয়া যায় না। দু’টা মেয়ে নিয়ে যেখানে সেখানেও তো উঠতে পারি না।
আমি নাচার! সামনের মাসের ১ তারিখ থেকে বাড়ি আমার লাগবেই।
শাহেদা কিছু বললেন না। নিঃশ্বাস ফেললেন। নিজামউদ্দীন বললেন, মানুষের সমস্যা মানুষ ছাড়া কে দেখবে? মানুষই দেখবে। আমি তো আপনাদের সমস্যা অনেকদিন দেখলাম। এখন আপনারা আমার সমস্যা একটু দেখুন।
শাহেদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আমার কোন সমস্যা দেখেছেন? আমি তো বিনা ভাড়ায় আপনার বাড়িতে থাকি নি। যথানিয়মে ভাড়া দিয়েছি। ভাড়া দিতে কখনো কখনো দেরি হয়েছে কিন্তু দেয়া হয়েছে।
ভাড়ার কথা তো আপা আসছে না। আপনাদের বাড়ি দেয়ার জন্যে কতরকম সমালোচনা সহ্য করেছি। দশজনের দশ রকম কথা।
কী কথা?
বাদ দেন, সব কথা শুনতে নাই।