রফিক দু’বোনকে দেখে হাসল। গতবার তার মুখভর্তি দাড়ি ছিল। এখন নেই। মাথার চুলও ছোট ছোট করে কাটা। তার গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। লম্বা হালকাপাতলা শরীর। জেলের বাইরে সাধারণ কোনো পোশাক পরিয়ে দিলেও তাকে দেখে সবাই বলবে, বাহু ছেলেটা সুন্দর তো! আজি তাকে মোটেই সুন্দর লাগছে না। তার চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। ঠোঁট ফ্যাকাসে। ঠোঁটের দু কোণায় ঘায়ের মতো হয়েছে। ঝুমুর কাঁপা গলায় বলল, কেমন আছ ভাইয়া?
রফিক মাথা নাড়ল। কিছু বলল না। তার স্বভাবও শাহেদার মতো। সেও কথা কম বলে।
ভাইয়া, তোমার কি শরীর খারাপ?
একটু খারাপ।
কী হয়েছে?
রাতে ঘুম হয় না।
মিতু বলল, তোমাদের জেলে ডাক্তার নেই?
আছে–ডাক্তার, হাসপাতাল সবই আছে।
ঘুম হচ্ছে না, সেটা তাহলে ডাক্তারকে বল। কতদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না?
রফিক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আগ্রহের সঙ্গে বলল, মা’র শরীর কেমন?
ভালো।
আমাকে দেখার জন্যে আসতে চায় না?
না।
এমনিতে শরীর ভালো?
হুঁ।
তোরা চলে যা, আর কী, দেখা তো হলো।
মিতু বলল, ভাইয়া তোমার শরীর কিন্তু খুবই খারাপ করেছে। তুমি ডাক্তারকে তোমার অসুখের কথা বল।
বলব।
ভাইয়া। তোমার জন্যে দুশ টাকা এনেছি। জেল গেটের জমাদার মোসাদেক আলীর কাছে দিয়েছি। তোমার কাছে পৌঁছবে তো?
অর্ধেক পৌঁছবে।
আর তোমার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট এনেছি।
সঙ্গে ম্যাচ আছে?
হ্যাঁ।
দে তাহলে একটা খাই।
রফিক সিগারেট ধরাল। নীরবে টানছে। ঝুমুর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছে। বলতে পারছে না। সে কোনোমতে বলল, জেলখানায় থাকতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না ভাইয়া?
রফিক সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, না, কষ্ট আর কী? মানুষ খুন করে জেলে আছি–ঠিকই তো আছে। অনেকে কোনো অপরাধ না করে খুনের দায়ে যাবজীবন জেল খাটছে। কষ্ট তাদের। তোরা চলে যা। মা’কে একবার ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসিস। উনার বয়স হয়েছে, হুট করে কোনোদিন মরে যাবেন, আর দেখা হবে না।
মিতু বলল, পরের বার যখন আসি নিয়ে আসব। ভাইয়া আমরা এখন যাই?
আচ্ছা যা। ঝুমুর ছয় মাসে এত বড় হয়ে গেল কীভাবে?
ঝুমুর লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমি বেশি বড় হইনি ভাইয়া। শাড়ি পরেছি। এই জন্যে বড় লাগছে।
মা যদি আমার কথা জানতে চায় তাহলে বলিস। আমি ভালোই আছি। রাতে ঘুম হচ্ছে না। এইসব বলার দরকার নেই।
ফেরার পথে তারা মোটামুটি ফাঁকা বাস পেয়ে গেল। ঝুমুর জানালার পাশে বসেছে। একটু পর পর চোখ মুছছে। ভাইয়াকে দেখে ফেরার পথে সব সময় সে এরকম কাঁদে। প্ৰতিবারই ভাবে সে মা’র মতো হয়ে যাবে–কখনো দেখতে যাবে না। কখনো না।
আজমল তরফদার
আজমল তরফদার মোবারক হোসেনের চেক ক্ষীণ সন্দেহ নিয়ে ব্যাংকে জমা দিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল। চেক ক্যাশ হবে না। বড়লোকদের নানান খেয়াল হঠাৎ মাথায় চাপে আবার হঠাৎই মিলিয়ে যায়। হঠাৎ উদয় হওয়া শখ হঠাৎ মেটাই স্বাভাবিক। চেক দেবার পর পরই হয়তো উনার শখ মিটে গেছে। উনি ব্যাংকে টেলিফোন করে বলে দিয়েছেন এত নাম্বারের চেক ক্যাশ করবেন না।
বড় চেকের সঙ্গে চিঠি দিতে হয়। ব্যাংক ম্যানেজার চিঠি না পেলে চেক ক্যাশ করেন না। অনেকে আবার আরেক কাঠি সরাস–কারেন্ট অ্যাকাউন্টে চেক না কেটে সেভিংস অ্যাকাউন্টে কাটে। আজমল তরফদার এইসব জটিলতার সঙ্গে পরিচিত। পরিচিত বলেই খানিকটা হলেও সন্দেহ নিয়ে তিনি ছিলেন। তিন দিনের ভেতরে চেক ক্যাশ হবার কথা, তারপরেও তিনি সাত দিন সময় দিলেন। সাত দিন পর ব্যাংকে টেলিফোন করে জানলেন চেক ক্যাশ হয়েছে।
তিনি তার পর পরই মোবারক সাহেবকে টেলিফোন করলেন। ছবি নিয়ে কথাবার্তা বলা দরকার। সামান্য বিয়ের মতো ব্যাপারে এক লাখ কথা খরচ হয়–আর এ হলো ছবি। কুড়িটা বিয়ে একসঙ্গে হবার মতো যন্ত্রণা–এখানে কথা বলতে হবে খুব কম করে হলেও কুড়ি লাখ।
টেলিফোন ধরলেন মোবারক সাহেবের পিএ। তিনি জানালেন, স্যার ব্যস্ত আছেন। কথা বলবেন না।
আজমল তরফদার বললেন, আপনি কি আমার নাম বলেছেন? বলেছেন যে ফিল্ম ডাইরেক্টর আজমল তরফদার। আমি স্যারের জন্যে ছবি বানাচ্ছি।
জ্বি আপনার নাম এবং পরিচয় বলা হয়েছে।
আমি কি পরে টেলিফোন করব?
করতে পারেন, তবে স্যার কথা বলবেন বলে মনে হয় না।
আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। এরকম মনে হবার কারণ কী?
কারণ সার বলেছেন ছবি নিয়ে যা কথা বলার তা বলা হয়েছে, নতুন কিছু বলার নেই।
আমার টেলিফোন নাম্বারটা রাখুন। যদি স্যার কথা বলতে চান।
দিন, টেলিফোন নাম্বার দিন।
আজমল তরফদার টেলিফোন নাম্বার দিয়েছেন। কেউ সে নাম্বারে টেলিফোন করে নি। ছবি তৈরি কোনো সহজ ব্যাপার তো না। স্ক্রিপ্ট রাইটারকে দিয়ে স্ক্রিপ্ট লেখাতে হবে, তাকে টাকা দিতে হবে; আর্টিস্ট ঠিক করতে হবে, তাদের শিডিউল নিতে হবে; এফডিসিতে চার লাখ টাকার মতো জমা দিতে হবে–এই কাজগুলো করবে কে? আজমল তরফদার আবার টেলিফোন করলেন। পিএ ধরল।
আমি ফিল্ম ডাইরেক্টর আজমল তরফদার…
কথা শেষ করার আগেই পিএ বলল, স্যার ব্যস্ত আছেন, কথা বলতে পারবেন না।
আজমল তরফদার বিরক্ত গলায় বললেন, কথা তো আমাকে বলতেই হবে, গল্প লাগবে, চিত্ৰনাট্য লাগবে, গান লাগবে –এর প্রতিটির জন্যে…