শেরীটা কী? মদ?
মদ বলবে না। মদ বললে মনে হয় ধেনো মদ। শেরী হলো মিষ্টি মিষ্টি এক ধরনের পানীয় যার অল্প খানিকটা পেটে গেলে জোছনা অনেক সুন্দর মনে হয়। বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে।
শেরী যারা খায় না তাদের বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না?
বেঁচে থাকার মধ্যে পার্থক্য আছে। সব বেঁচে থাকা একরকম না।
ঝুমুর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এইসব চাকরি আপনাকে মানবে না মবিন ভাই। আপনি যা আছেন, তাই আপনাকে মানাচ্ছে। ছোট্ট সুন্দর একটা ঘর। পাটি বিছানো চৌকি …বাহ্।
মবিন হো-হো করে হেসে ফেলল। ঝুমুর অপ্ৰস্তুত হয়ে বলল, হাসলেন কেন?
আছে একটা কারণ। তোমাকে বলা যাবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে বলতে না চাইলে বলবেন না–শুধু একটা সত্যি কথাই বলুন। আমাকে খুশি করার জন্যে মিথ্যা বলতে পারবেন না।
আচ্ছা যাও সত্যি কথাই বলব।
শাড়ি পরায় আমাকে কি খুব সুন্দর লাগছে?
যে সুন্দর সে যাই পারুক তাকে সুন্দর লাগবে।
আমি কি সুন্দর মবিন ভাই?
অবশ্যই সুন্দর।
আপা বেশি সুন্দর, না। আমি? সত্যি কথা বলতে হবে কিন্তু।
দু’জনের সৌন্দৰ্য দু’রকম। কোনো দু’জন রূপবতী মেয়ের ভেতর তুলনা চলে না। একেক জনের সৌন্দৰ্য একেক রকম। কেউ নদীর মতো, কেউ অরণ্যের মতো, আবার কেউ আকাশের মতো!
আমি কীসের মতো?
ঝরনার মতো।
আর আপা?
সে অরণ্যের মতো।
অরণ্য বেশি সুন্দর না ঝরনা?
কারো কারো কাছে অরণ্য সুন্দর, কারো কাছে ঝরনা।
ঝুমুর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনার কাছে অরণ্য সুন্দর তাই না? এই জন্যেই চা বাগানের চাকরি আপনার এত পছন্দ, ঠিক না?
মবিন জবাব দিল না। সে একটু অস্বস্তির সঙ্গে শাড়ি পরা মেয়েটির দিকে তাকাল।
ঝুমুর ঠিক আড়াইটার সময় এফডিসির গেটে এসেছে। তখন থেকেই সে অপেক্ষা করছে। আপার বেরুবার নাম নেই। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা খুব অস্বস্তিকর। একগাদা লোক দাঁড়িয়ে আছে। কোনো একটা গাড়ি এফডিসির ভেতরে ঢুকলেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। নায়ক-নায়িকা কাউকে এক ঝলক দেখা যায় কিনা।
কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নায়ক-নায়িকারা আসছে পর্দ ঢাকা গাড়িতে। অনেকের গাড়ির কাচ টিনটেড। বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। একগাদা মানুষের ভেতর ঝুমুর একাই মেয়ে। সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। একজন এসে জিজ্ঞেস করল সে এফডিসির ভেতর ঢুকতে চায় কিনা। ঝুমুর ভীত গলায় বলল, না।
ভিতরে যাইতে চাইলে সমস্যা নাই–নিয়া যাব।
জ্বি না, আমি যাব না।
লোকটা তবু তাকে ছাড়ছে না। তার আশপাশেই আছে। ভদ্রলোকের মতো চেহারা কিন্তু মতলববাজ তা বোঝাই যাচ্ছে–নয়তো ঝুমুরকে এফডিসির ভেতর নিয়ে যাবার ব্যাপারে তার এত আগ্রহ হবে কেন? সময় কতক্ষণ গেছে ঝুমুর বুঝতে পারছে না। তার সঙ্গে ঘড়ি নেই। লোকটাকে অবশ্যি জিজ্ঞেস করা যায়। তার হাতে বাহারি ঘড়ি।
আচ্ছা আপা কোনো কারণে বাসায় চলে যায় নি তো? যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে তো সে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে। একা একা ফিরতে হবে জয়দেবপুর। এই বদলোক নিশ্চয়ই তার পেছনে পেছনে যাবে।
ঝুমুর।
ঝুমুর চমকে তাকাল। মিতু বের হয়েছে। তার মুখে মেকআপ। ঠোঁট টকটকে লাল। তাড়াতাড়ি আসার জন্যে মেকআপ তোলারও সময় পায় নি।
তুই কি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস?
হুঁ। তোমার শাড়ি পরে চলে এসেছি। রাগ কর নি তো?
না, শুধু শুধু রাগ করব কেন? চল যাই–আয় একটা রিকশা নিয়ে নিই। একা একা আসতে ভয় লাগে নি তো?
উঁহুঁ।
বাহ্। তোর তো সাহস বেড়েছে। কিছুক্ষণ হাঁটতে পারবি ঝুমুর?
হুঁ পারব।
তাহলে আয় একটু হাঁটি–বাংলামোটর পর্যন্ত গেলে টেম্পো পাওয়া যাবে।
তুমি ঢাকা শহরে সব রাস্তাঘাট চেন তাই না?
মোটামুটি চিনি।
আপা, বাসায় চিনি নাই, চা নাই।
মিতু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। সেই নিঃশ্বাস ফেলা দেখে ঝুমুর নিশ্চিত বুঝল আপার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই।
তোর কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে ঝুমুর?
উঁহুঁ।
হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্যেও ভালো।
তুমি তো আর স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্যে হাঁটছ না, দায়ে পড়ে হাঁটছ। গাড়ি থাকলে তুমি কি আর স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যে হাঁটতে?
তাও ঠিক।
আপা, আজ খুব ভোরবেলা বাড়িওয়ালা এসেছিল দু’টা পেঁপে নিয়ে। তার বাগানের পেঁপে। মা’র সঙ্গে কথা বলল।
বাড়ি ছেড়ে দিতে বলল?
হুঁ।
বেশি ভাড়ার ভাড়াটের কাছে ভাড়া দেবে?
তা বলল না। তার নিজের জন্যেই বাড়ি দরকার। সংসার বড় হয়েছে, ছোট ছেলে হুট করে বিয়ে করে ফেলেছে–এইসব কথা।
মা কী বলল?
মা কিছুই বলে নি, শুধু শুনেছে।
হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে ঝুমুর?
না।
এই তো এসে পড়েছি।
আমরা কি সত্যি সত্যি-টেম্পোতে করে একদল পুরুষের সঙ্গে গা ঘেসাঘেঁসি করে যাব? আমার তো ভাবতেই বমি আসছে।
তোকে এক কোণায় বসিয়ে দেব। তোর আর কারো সঙ্গে গা ঘেঁসে যেতে হবে না।
তোমার তো যেতে হবে।
আমার এইসব গা সহা হয়ে গেছে।
আমাদের মতো খারাপ অবস্থায় বোধহয় কেউ নেই, তাই না আপা?
থাকবে না কেন, আমাদের চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থায় লোক আছে। আমার পরিচিত এক মেয়ে আছে–ওর নাম টেপী। ছবিতে ছোটখাটো রোল করে। বিরাট সংসার তাকে একা টানতে হয়। ছবির পয়সায় তো হয় না–কিছু জঘন্য কাজ তাকে করতে হয়।
জঘন্য কাজটা কী?
মিতু জবাব দিল না। টেম্পোস্ট্যান্ড চলে এসেছে। সে বোনের হাত ধরে খালি টেম্পো খুঁজছে। সবার আগে উঠলে ঝুমুরকে কোণার দিকে নিরাপদ জায়গায় বসাতে পারবে।