শাহেদা জবাব দিলেন না।
আমি কি এই কামিজটা পরেই যাব?
তোর যা ইচ্ছা পর।
কামিজটা যা নোংরা হয়ে আছে। আপার একটা শাড়ি পরে ফেলব মা?
শাহেদা জবাব দিলেন না। কথাবার্তা তিনি এমনিতেই কম বলেন–যত দিন যাচ্ছে কথাবার্তা আরো কমিয়ে দিচ্ছেন।
ঝুমুর ঘর থেকে বের হয়ে অসীম সাহসী এক কাণ্ড করল। মবিনের মেসে যাবার জন্যে একটা রিকশা ঠিক করে ফেলল। কাজটা অসীম সাহসিক এই কারণে যে মবিনকে যদি না পাওয়া যায় তাহলে সে ঘোরতর সমস্যায় পড়বে। টাকায় টান পড়ে যাবে। ফার্মগেট থেকে নেমে এফডিসি যেতে হবে হেঁটে হেঁটে। সে চিনে যেতে পারবে কিনা তাও এক সমস্যা। বাইরে একা বেরোলেই তার শুধু সমস্যা হয়। হয়তো স্যান্ডেলের স্ট্যাপ ছিঁড়ে যাবে। তাকে যেতে হবে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে। তারচে’ বড়ো সমস্যাও হতে পারেহয়তো ইতিমধ্যে মবিন ভাই তার ঘর বদলেছেন। সে দরজির দোকানের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজায় নক করল। দরজা খুলল–দেখা গেল ভয়ঙ্কর দর্শন কয়েকজন চৌকিতে বসে তাস খেলছে। সবার সামনে মদের গ্লাস। ঝুমুর কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, মবিন ভাই কি এখানে থাকেন না? একজন চাপা গলায় উত্তর দিল, জ্বি না খুকুমণি, উনি থাকেন না। তাতে কী হয়েছে আমরা তো থাকি?
সেই লোকটা তারপর মাথা ঘুরিয়ে কোণায় বসে থাকা এক লোককে বলল–ঐ যা তো মেয়েটাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দে। মুখে রুমাল ওঁজে দে। নয়তো চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে।
ঝুমুর দরজার কড়া নাড়ল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। মবিন বলল, ঝুমুর তুমি, ব্যাপার কি?
আমি ঢাকা যাব মবিন ভাই।
ঢাকা যাবে অতি উত্তম কথা। এটা তো ঢাকা যাবার দোতলা বাস না যে তুমি দোতলায় উঠে এলে।
আপনি আমাকে ঢাকার বাসে তুলে দেবেন।
অতি উত্তম তুলে দেয়া হবে।
শুধু তুলে দিলে হবে না। আপনাকে আমার সঙ্গে এফডিসির গেট পর্যন্ত যেতে হবে।
ব্যাপার কী?
আজ ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করার ডেট। আপা আমাকে বলেছে আড়াইটার সময় এফডিসির গেটে থাকতে। একা একা আমি কোথাও যাই না। তবু …
কোনো সমস্যা নেই, তোমাকে একা একা যেতে হবে না।
আপনি কিন্তু আমাকে নামিয়ে দিয়েই চলে যাবেন এবং আপনি যে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছেন সেটা আপাকে বলবেন না।
এত গোপনীয়তা কেন?
আপাকে বললেই আপার কাছ থেকে মা জানবে। মা খুব রাগ করবে। এই ক্ষেত্রে গোপনীয়তাই শ্ৰেয়। আড়াইটার সময় পৌঁছতে হবে?
হুঁ।
তাহলে বোস কিছুক্ষণ, আমি ভাত খেয়ে নি।
আচ্ছা।
তুমি খেয়ে এসেছ?
হুঁ।
আমার সঙ্গে চারটা খাবে?
খেতে পারি। আমি কি আপনার বিছানায় পা তুলে বসব মবিন ভাই?
অবশ্যই বসবে।
আপনার ঘরে ঢুকলেই কেমন শান্তি শান্তি ভাব হয়। কেন বলুন তো মবিন ভাই?
ঘরটা ফাঁকা তো–কোনো আসবাব নেই–একটা চৌকি, একটা চেয়ার। চৌকিতে শীতলপাটি বিছানো। শীতলপাটি মানেই শান্তি, ফাঁকা ঘর মানেই শান্তি। এই জন্যে আমার ঘরে পা দিলেই শান্তি শান্তি ভাব হয়।
আপনি কি আপার সঙ্গেও এরকম করে কথা বলেন, না আপার সঙ্গে অন্যরকম করে কথা বলেন?
এরকম করেই কথা বলি।
সে কি আপনার কথা শুনে খুশি হয়?
জিজ্ঞেস করি নি কখনো।
জিজ্ঞেস করতে হবে! মুখ দেখেই তো বোঝা যায়।
আমি তোমার আপার মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারি না।
আমিও পারি না।
মবিন খবরের কাগজ বিছাচ্ছে। টিফিন কেরিয়ারের বাটি বের করছে। ঝুমুর বলল, আমাকে কি আজ একটু অন্যরকম লাগছে না?
হুঁ লাগছে।
কেন অন্যরকম লাগছে বলুন তো?
শাড়ি পরেছ এই জন্যেই অন্যরকম লাগছে।
ও আপনি তাহলে লক্ষ করেছেন। আমি ভাবলাম বোধহয় লক্ষ করেন নি।
লক্ষ করব না কেন, করেছি।
যারা দিনরাত বই পড়ে তারা বই ছাড়া আর কিছুই লক্ষ করে না।
আমি করি।
ঝুমুর বাসায় কিছু খেতে পারে নি। এখানে একগাদা ভাত খেয়ে ফেলল। হাসিমুখে বলল, মবিন ভাই, ঘুমে এখন আমার চোখ জড়িয়ে আসছে। আপনার শীতলপাটিতে ঘুমুতে নিশ্চয় খুব আরাম।
আমার তো আরামই লাগে।
আমি একদিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে আপনার শীতলপাটিতে এসে আরাম করে ঘুমুব।
বাসায় আরাম করে ঘুমুতে পার না?
না, এতটুকু একটা বিছানা, আপা আর আমি দু’জন ঘুমাই। খুব চাপাচাপি হয়। মা’র বিছানাটা বড় কিন্তু মা’র সঙ্গে ঘুমুতে ইচ্ছা করে না। মা’র রাতে ঘুম হয় না তো–সারারাত এপাশি-ওপাশ করে। মাঝে মাঝে কাঁদে। তার গায়ের সঙ্গে গা লাগলে কী করে জানেন? ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
ঝুমুর চল, ওঠা যাক। এখন রওনা না হলে আড়াইটার সময় পৌঁছাতে পারবে না।
ঝুমুর অনিচ্ছার সঙ্গে উঠল। মবিন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে তার সব সময়ই ভালো লাগে। আজ অন্য দিনের চেয়েও ভালো লাগছে।
মবিন ভাই!
হুঁ।
আপনাদের বিয়ে কবে হবে?
বুঝতে পারছি না। চাকরি বাকরি ছাড়া বিয়ে করা ঠিক হবে না।
চাকরির আশায় বসে থাকলে আপনার আর বিয়ে হবে না।
তোমার ধারণা আমার চাকরি বাকরি হবে না?
হুঁ।
ভুল ধারণা। আমি বিরাট একটা চাকরি পাব। চা বাগানের ম্যানেজার। বাংলো টাইপ একটা বাড়ি থাকবে, মালী থাকবে, সুইপার থাকবে। চা বাগানে ঘোরার জন্যে ল্যান্ড রোভার জিপ থাকবে। বিকেলে আমাদের অফিসার্স ক্লাবে গিয়ে হাফপ্যান্ট আর টি শার্ট পরে লং টেনিস খেলিব। জোছনা রাতে বাংলোর বারান্দায় আমি আর তোমার আপা রকিং চেয়ারে বসে চুকচুক করে শেরী খাব এবং জোছনা দেখব।