শাহেদা রান্নাঘরে থালাবাসন ধুচ্ছিলেন। ঝুমুর এসে তাঁর পাশে বসল। শাহেদা বললেন, কী হয়েছে?
ঝুমুর বলল, জ্বর জ্বর লাগছে মা।
শুয়ে থাক।
ঝুমুর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। তার ধারণা পৃথিবীর সব মা ‘জ্বর জুর লাগছে’ এই বাক্য শোনার পর সন্তানের কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখবে। শুধু তার মা শুকনো গলায় বলবো ‘শুয়ে থাক’।
ভাইয়ার জন্যে কিছু রেঁধে টেধে দেবে?
কী রাঁধব?
পায়েস বা এই জাতীয় কিছু। সবাই খাবার টাবার নিয়ে যায়—আমরা শুধু যাই খালি হাতে।
তোদের কিছু নিতে ইচ্ছে হলে নিজেরা রেঁধে নিয়ে যা।
ঝুমুর আর কিছু বলল না। তবে সে উঠে গেল না, মা’র পাশে বসে রইল। ঘরে তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই। আপা শুটিঙে গেছে। সে বাসায় ফিরবে না। এফডিসির গেট থেকে আপাকে তুলে নিতে হবে। জয়দেবপুর থেকে তাকে একা একা যেতে হবে এফডিসি, এটাও তার জন্যে বিরাট সমস্যা। তার সাহস একেবারেই নেই। স্কুল থেকে সে বাসায়ও একা একা আসতে পারে না। তার এক বান্ধবীর সঙ্গে আসে। সেই বান্ধবী তাকে তাদের বাসার গেট পর্যন্ত দিয়ে তারপর তার বাসায় যায়। আজ একা একা এফডিসি পর্যন্ত কী করে যাবে কে জানে। যাওয়া অবশ্য খুব সোজা। ফার্মগেটে বাস থেকে নেমে একটা রিকশা নিতে হবে। পাঁচ টাকা নেবে রিকশা ভাড়া। আপা কখনো রিকশা নেয় না। বাস থেকে নেমে সে হেঁটে হেঁটে যায়। তার পক্ষে সম্ভব না। তাকে উপায় না থাকলেও পাঁচ টাকা খরচ করতে হবে।
মা।
হুঁ।
একা একা এফডিসির গেট পর্যন্ত যাব কীভাবে?
মিতু যেভাবে যায় তুইও সেইভাবে যাবি। তোর জন্যে চৌকিদার পাব কোথায়?
মবিন ভাইকে বলব আমাকে পৌঁছে দিতে?
না।
অসুবিধা তো কিছু নেই। উনার যদি কাজ না থাকে…
তোর যাবার দরকার নেই। তোর আপা একাই যাবে।
মবিন ভাইকে তুমি এত অপছন্দ কর কেন?
পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার না, শুধু শুধু বাইরের একটা মানুষকে বিরক্ত করবি কেন?
উনি বাইরের মানুষ না, দুদিন পর বিয়ে হচ্ছে আপার সঙ্গে।
যখন হবে তখন দেখা যাবে।
ঝুমুরকে রান্নাঘরে রেখে তিনি উঠে গেলেন। বালতিতে কাপড় ভেজানো আছে। কাপড় ধুবেন। ঝুমুর একা একা বসে রইল। তার এখন ইচ্ছা করছে কলঘরে মা’র পাশে গিয়ে বসতে। সে একা একা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।
হঠাৎ ঝুমুরের মনে হলো, তার যখন বিয়ে হবে তখন তার স্বামী বেচারা খুব ঝামেলায় পড়বে। সারাক্ষণ সে স্বামীর সঙ্গে থাকবে। কে জানে সে হয়তো অফিসেও চলে যাবে। স্বামী কাজ করছে–সে তার সামনের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। ঝুমুরের এইসব ভাবতে খুব লজ লাগছে আবার না ভেবেও পারছে না। ইদানীং সে এইসব ব্যাপার নিয়ে খুব ভাবে। সে যখন একা থাকে। শুধু যে তখন ভাবে তা না, যখন অনেকের সঙ্গে থাকে তখনো ভাবে। সবচে’ বেশি ভাবে ক্লাসে। আপা অঙ্ক করাচ্ছেন। সবাই বোর্ড থেকে অঙ্ক টুকছে আর সে ভাবছে অন্য কিছু। সেই অন্য কিছু মানে খারাপ কিছু না, আবার খারাপও। যেমন–আপা যখন অঙ্ক করাচ্ছিলেন তখন সে ভাবছে… ভাবছে না, পরিষ্কার চোখের সামনে দেখছে লাল রঙের একটা গাড়ি স্কুলে ঢুকল। গাড়ি থেকে একজন নামল–তার পরনে ধবধবে সাদা প্যান্ট, গায়ে চকলেট রঙের হাওয়াই শার্ট। শার্টের রঙটা কটকট করে চোখে লাগছে। তাকে দেখেই সে বের হয়ে আসছে। অঙ্ক আপা কঠিন গলায় বললেন, এই ঝুমুর কোথায় যাচ্ছ?
সে লজ্জিত গলায় বলল, আমার হাসবেন্ড আমাকে নিতে এসেছে আপা।
ও আচ্ছা যাও। তুমি কিন্তু খুব ক্লাস মিস দিচ্ছ।
না গেলে ও খুব রাগ করবে।
আচ্ছা যাও। উনাকে বলবে স্ত্রীর পড়াশোনার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। শুধু সঙ্গে নিয়ে ঘুরলে হবে না।
জ্বি, আপা বলব। সে বের হয়ে হনহন করে গাড়ির দিকে এগুল। তারপর বিরক্ত গলায় বলল, আচ্ছা তোমাকে কতবার না বলেছি। চকলেট কালারের এই শার্টটা পরবে না। তারপরেও পরেছ?
হাতের কাছে পেয়েছি, পরে চলে এসেছি।
তুমি এই শার্ট গায়ে দিয়ে থাকলে আমি কোথাও যাব না।
তাহলে শার্ট খুলে ফেলি, শার্টের নিচে স্যান্ডো গেঞ্জি আছে। স্যান্ডো গেঞ্জি পরা থাকলে যাবে?
আবার ঠাট্টা করছ?
ঝুমুরের চোখে পানি এসে গেছে। সে সবার ঠাট্টা সহ্য করতে পারে, এই মানুষটার ঠাট্টা সহ্য করতে পারে না। ঝুমুরের চোখে পানি দেখে সে লজ্জিত ভঙ্গিতে এসে তার হাত ধরল। ঝুমুর ঝটিকা মেরে সেই হাত সরিয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বলল, ছিঃ এইভাবে হাত ধরলে–ক্লাসের সব মেয়েরা তাকিয়ে আছে, আপারা দেখছে।
দেখুক। তুমি কাঁদবে কেন?
আমি এক শ বার কাঁদব।
আমিও এক শ বার হাত ধরব।
এইসব ভাবতে ঝুমুরের এত ভালো লাগে! যা ভাবা হয়। সত্যিকার জীবনে তা কখনো ঘটে না। ঝুমুরের নিশ্চিত ধারণা তার বিয়েই হবে না। আর হলেও পানের দোকানদার টাইপ কারো সঙ্গে হবে। যার গায়ে সবসময়ই ঘাম আর কড়া সিগারেটের গন্ধ থাকবে।
দুপুরে ঝুমুর কিছু খেতে পারল না। তাকে একা একা ঢাকা যেতে হবে এই টেনশানেই তার মুখে কিছু ভালো লাগছে না। কেমন যেন গা গুলাচ্ছে। ঝুমুর বলল, মা তুমি আমাকে বাসে তুলে দিয়ে আস।
শাহেদা শান্ত গলায় বললেন, কোথাও তুলে দিতে পারব না। তুই নিজে নিজে বাস খুঁজে বের করবি। নিজে নিজে উঠবি।
আচ্ছা। ভাইয়াকে কিছু বলতে হবে?
না।
আপাকে কিছু বলতে হবে?
ঘরে চা নাই, চিনি নাই।
চা চিনি ছাড়া আর সব আছে?