লোকমান উঁকি দিল। তিনি সহজ গলায় বললেন, কিছু বলবে লোকমান?
লোকমান বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আপনি ডাক্তার সাহেবকে আসতে বলেছেন, উনি এসেছেন।
এখানে নিয়ে এস।
দুপুরের খাবার কি স্যার এখানে দেব?
দাও। ডাক্তারকেও আমার সঙ্গে খেতে বলেছিলাম।
জ্বি স্যার জানি।
ডাক্তার আবদুর রশীদ ইএনটি স্পেশালিস্ট। মোবারক সাহেবের নাক-কান-গলার কোনো সমস্যা নেই। তবু রশীদ সাহেবকে তিনি প্রায়ই খবর দিয়ে আনেন কথা বলার জন্যে। রশীদ সাহেব ভদ্রলোকের অনেক ক’টা বিলিতি ডিগ্রি আছে কিন্তু প্র্যাকটিস নেই। ইএনটি স্পেশালিস্টরা রোগী সামলাতে হিমশিম খান। রশীদ সাহেবের সেই সমস্যা নেই। তার বেশিরভাগ সময় কাটে খবরের কাগজ পড়ে। তিনি চারটি খবরের কাগজ রাখেন। চেম্বারে বসে চারটা খবরের কাগজ পড়ারই তাঁর সময় হয়।
এই মানুষটির বিস্মিত হবার ক্ষমতা অসাধারণ। মোবারক সাহেব মাঝেমধ্যে তাকে খবর দিয়ে আনেন। সামান্য ব্যাপারে ভদ্রলোককে বিস্মিত হতে দেখেন। তার ভালো লাগে। মেডিকেল কলেজের একজন নামি অধ্যাপক–তাকে তো আর যখন তখন খবর দিয়ে আনা যায় না। অসুখের একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে খবর দিতে হয়। রোগ দেখানোর পর অবিশ্বাস্য অঙ্কের একটা চেক তাঁর হাতে দেয়া হয়। তিনি চেকটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ খুব হৈচৈ করেন–করেছেন কী! পত্রিকাওয়ালারা জানলে তো নিউজ করে ফেলবে। অসম্ভব, এই চেক আমি নিতে পারি না। আপনার যদি টাকা বেশি হয়ে থাকে এবং দান করতে যদি কষ্ট হয় তাহলে দয়া করে টাকাগুলো পুড়িয়ে ফেলুন। আমাকে নষ্ট করবেন না। আমি এমনিতেই নষ্ট।
ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত চেকটা নেন। এবং ছেলেমানুষের মতো বলে ফেলেন–চেকটা পেয়ে খুব উপকার হয়েছে, প্র্যাকটিস বলতে কিছুই নাই। চেম্বারে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট রেখেছিলাম, তিন মাস বেতন না দেয়ায় চলে গেছে। শুধু হাতে যায় নি, আমার ইন্সট্রুমেন্ট বক্স নিয়ে পালিয়ে গেছে। ত্রিশ-পঁয়ত্ৰিশ হাজার টাকা দামের ইন্সট্রুমেন্ট।
রশীদ সাহেব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, মোবারক সাহেব, আবার আপনার কী হলো?
ঢোক গিলতে ক’দিন ধরে সমস্যা হচ্ছে।
টনসিলাইটিস নাকি? হাঁ করুন তো।
এক্ষুণি হাঁ করব না। খানিকক্ষণ গল্পগুজব করুন তারপর হাঁ করি।
আরে সর্বনাশ! এগুলো কি গোলাপ নাকি। আপনি করেছেন কী–ছাদে দেখি আমার আগুন লাগিয়ে ফেলেছেন! দু’টা মিনিট সময় দিন আমি একটু বাগানটা দেখে আসি।
রশীদ সাহেব গভীর আনন্দে গোলাপ দেখে বেড়ান। মোবারক সাহেব তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। রশীদ সাহেবকে তিনি ব্যবহার করেন। ঠিক একইভাবে তিনি আরো অনেককে ব্যবহার করেন। কিন্তু তারপরেও তাঁর কিছুই ভালো লাগে না। পর পর দু’বার তিনি তিনতলার বারান্দা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়তে গিয়ে পড়েন নি। আরো একবার একরকম কিছু হবে। সেই বার তিনি হয়তো সত্যি সত্যি লাফিয়ে পড়বেন।
জীবনের বৈচিত্র্যের জন্যে টেপীর মতো মেয়েদের তিনি মাঝে মাঝে নিয়ে আসেন। তাদের কেউ কেউ অদ্ভুত সব কাণ্ড করে। কিছুক্ষণের জন্যে জীবনটা ইন্টারেস্টিং মনে হয়–তারপর আবার সেই ক্লান্তিকর দীর্ঘ দিবস। দীর্ঘ রাজনী। একবার বাইশ-তেইশ বছর বয়সী একটি মেয়ে এসেছিল। সে ভয়ে এবং লজ্জায় মরে যাচ্ছে। বিছানার এক কোণায় বসেছিল। মোবারক সাহেবকে দেখেই চট করে উঠে দাঁড়াল। হড়বড় করে বলল, আমি ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারি না। আমি কিন্তু কাপড় খুলব না।
সেদিন তিনি প্ৰাণ খুলে হেসেছিলেন। মেয়েটিকে কাপড় খুলতে হয় নি। তিনি তাকে কফি বানিয়ে খাইয়েছেন। যতদূর মনে পড়ে তাকে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তাকে বলেছিলেন, তোমার যখনই টাকা-পয়সার সমস্যা হবে তুমি আমার কাছে আসবে, টাকা নিয়ে যাবে।
মেয়েটি আর আসে নি। তিনি খবর নিয়েছিলেন। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। সে স্বামীর সঙ্গে জামালপুরে থাকে। সে সুখেই আছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই সুখে থাকে। অল্প কিছু লোক থাকে অসুখী–তারা শুধু সুখী মানুষ খুঁজে বেড়ায়।
ঝুমুর আজ স্কুলে যায় নি
ঝুমুর আজ স্কুলে যায় নি। বিকেল তিনটায় সে আপাকে সঙ্গে নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবে। সে সকাল থেকেই অস্বস্তি নিয়ে ঘুরছে। সেন্ট্রাল জেলের গেটে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে তার কুৎসিত লাগে। চারপাশে থাকে গাদাগাদি ভিড়। দর্শনাথীর চেয়ে বাইরের লোক বেশি। এরা এমন ভঙ্গিতে তাকায় যেন যারা দেখা করতে এসেছে তারাও অপরাধী।
সবচে’ খারাপ লাগে যখন তারা গরাদ ধরে অপেক্ষা করতে থাকে এবং কয়েদির পোশাক পরা রফিক হাসিমুখে উপস্থিত হয়। পায়ে লোহার বালা। সেই বালা থেকে ঝন ঝন শব্দ হয়। একটা বালা থেকে এমন শব্দ হয় কেন ঝুমুর জানে না। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। প্রশ্নটা হাস্যকর হবে ভেবে কখনো জিজ্ঞেস করা হয় না।
প্রতিবারই রফিককে অন্যরকম লাগে। শেষবার দেখা করতে গিয়ে ঝুমুর একটা ধাক্কা খেল–রফিকের মুখভর্তি দাড়ি। দেখে মনে হয় মাদ্রাসার বাচ্চা মওলানা। আজ গিয়ে কী দেখবে কে জানে। ঝুমুরের যেতে ইচ্ছা করছে না। তবু সে যাবে। সে না গেলে আপাকে একা একা যেতে হবে। বেচারি সবকিছু একা করবে তা কি হয়? মা কখনো যাবে না। দু’ বছরে একবারও যায় নি। মাসে একটা চিঠি লেখা যায়, সেই চিঠিও লিখবে না।