মোবারক সাহেব বললেন, আপনার বোধহয় সিগারেট খাবার অভ্যাস আছে। অভ্যাস থাকলে খেতে পারেন। আমিও মাঝেমধ্যে খাই।
তিনি তাঁর সামনে ছোট্ট ডেস্ক টাইপ টেবিলের ড্রয়ার খুলে অ্যাশট্রে বের করে সামনে রাখলেন। আজমল তরফদার ভুরু কুঁচকে ফেললেন। কথাবার্তার ঠিক এই পর্যায়ে ড্রয়ার থেকে অ্যাশট্রে বের করা হবে এটা কি আগেই ঠিক করা?
মোবারক সাহেব একটু ঝুকে এসে বললেন, আমি আপনাকে দিয়ে ছবি বানাব বলে ঠিক করে রেখেছি। আপনার রেমুনারেশন হিসেবে আমি পাঁচ লাখ টাকা ভেবে রেখেছি। এই অ্যামাউন্টের টাকার একটা চেক তৈরি করা আছে। আপনি রাজি থাকলে আজই আপনাকে দিয়ে দেব।
পুরোটা একসঙ্গে দিয়ে দেবেন?
হ্যাঁ। এবং ছবি যদি সুপারহিট হয় তাহলে আপনাকে আরো দু লাখ দেয়া হবে। আপনি কি রাজি আছেন?
রাজি আছি।
কতদিনে ছবি তৈরি করে দেবেন?
আমি ছ’মাসে ছবির সেন্সরপ্রিন্ট দিয়ে দেব। এবং ইনশাআল্লাহ্ ছবি সুপারহিট করবে। তবে একটা শর্ত–ছবি আমার মতো করে বানাতে দিতে হবে।
তা দেব। শুধু টাকা-পয়সা আমার লোকজন হ্যান্ডেল করবে। এবং নায়িকা হিসেবে আমার পরিচিত একটি মেয়ে থাকবে। আপনি তাকে চেনেন। আপনার বর্তমান ছবিতে কাজ করছে। রেশমা।
রেশমা?
হ্যাঁ।
আপনি স্যার দেড় কোটি টাকা খরচ করছেন, ইচ্ছে করলে বর্তমানের সবচে’ হিট নায়িকা নিতে পারেন।
আমি ঐ মেয়েটিকে নিতে চাচ্ছি।
স্যার কিছু মনে করবেন না। ওর চেহারায় গ্ল্যামার নেই। ছবির জগতটাই হলো গ্ল্যামারের।
ফিল্ম লাইনের মেকআপ দিনকে রাত করতে পারে। সামান্য গ্ল্যামার আনতে পারবেন না?
সে রকম মেকআপম্যান স্যার আমাদের নেই।
না থাকলে বাইরে থেকে নিয়ে আসুন। মাদ্রাজ থেকে আনুন, বোম্বে থেকে আনুন। প্রয়োজন মনে করলে হলিউড থেকে আনুন।
শরবত চলে এসেছে। আজমল তরফদার অস্বস্তির সঙ্গে শরবতের গ্রাস হাতে নিলেন। তাঁর কাছে মনে হলো–পাঞ্জাবি গায়ে বসে থাকা ছোটখাটো মানুষটা আসলে মাকড়সার মতো। সূক্ষ্ম জাল ফেলে রাখে। সে জাল চোখে দেখা যায় না। জালে জড়িয়ে পড়ার পরই শুধু জালটা স্পষ্ট হয়।
আজমল সাহেব।
জ্বি স্যার।
এই নিন। আপনার চেক।
টেবিলের ড্রয়ার থেকে চেক বের হলো। আজমল তরফদার হাত বাড়িয়ে যন্ত্রের মতো চেকটা নিলেন। চাপা গলায় বললেন, আপনার সঙ্গে আমার আবার কবে দেখা হবে?
আর দেখা হবে না। আমার লোক আপনার সঙ্গে সাৰ্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবে।
যদি বিশেষ কোনো প্রয়োজন পড়ে?
প্রয়োজন পড়লে আমি আছি। আমি তো দেশেই থাকি। তবে নানান কাজে ব্যস্ত থাকি।
ছবির গল্প কি আমিই সিলেক্ট করব?
অবশ্যই আপনি করবেন।
আপনাকে দেখানোর কোনো দরকার নেই?
না।
এফডিসির ক্যামেরা না নিয়ে প্রাইভেট পার্টির ক্যামেরা দিয়ে যদি কাজ করি আপনার আপত্তি আছে? জার্মানির এরি থ্রি ক্যামেরা। নতুন এসেছে। এরা টাকা একটু বেশি নেবে কিন্তু কাজ হবে খুব ভালো।
আপনি কাজ করবেন স্বাধীনভাবে। আমি বা আমার লোকজন কখনোই আপনার স্বাধীন কাজে বাধা দেবে না।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
আজমল তরফদার উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর পা সামান্য টলছে। সম্ভবত পার পর দু’পেগ ভদকার জন্যে এটা হয়েছে। ভদকা হঠাৎ করে ‘কিক’ দেয়। এটা কি ভদকার কিক, না অন্য কিছু? স্কুল টিচারের মতো দেখতে এই লোকটা তাকে নার্ভাস করে দিয়েছে।
স্যার।
বলুন।
আর্টিস্টদের সঙ্গে কি যোগাযোগ করব?
স্টোরি লাইন ঠিক হবার আগে আর্টিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন কীভাবে?
এদিকের নিয়ম হচ্ছে স্যার–আগে আর্টিস্ট ঠিক করা হয় তারপর স্টোরি লাইন।
নিয়ম যা তাই করবেন। তবে রেশমা মেয়েটিকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি ডিসিশান বদলাতেও পারি।
যদি কিছু মনে না করেন স্যার তাহলে ডিসিশান বদলানো ভালো হবে। সম্পূর্ণ নতুন মেয়ে নেয়া এক কথা আর দিনের পর দিন এক্সটার রোল করছে এমন একজনকে নেয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। নতুন একজন নায়িকার জন্যে দর্শকদের কৌতুহল আছে। এক্সট্রা মেয়েদের জন্যে দর্শকদের কৌতুহল নেই। স্যার যাই।
মোবারক সাহেব জবাব দিলেন না। আজমল তরফদারের পা সত্যি সত্যি টলছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি প্রয়োজনের চেয়েও বেশি বার ‘স্যার’ ‘স্যার’ করেছেন। এত ‘স্যার’ ‘স্যার’ করার কোনো দরকার ছিল না। এটা তো আর মিলিটারি একাডেমি না যে স্যারের উপর দুনিয়া চলবে।
মোবারক সাহেব ঘরে একা বসে আছেন। আজমল তরফদার নামের সিনেমায় এই লোক তাকে খুব বিরক্ত করেছে। লোকটার চোখে কোনো অসুখ আছে। টকটকে লাল চোখ। তিনি লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হচ্ছিলেন। বিরক্তি অনেক বাড়ল যখন সে মিথ্যা কথা বলে তার পাওনা বাড়াতে চাইল। লোভীর মতো লোকটির চেক নেয়াটাও চোখে লেগেছে।
পৃথিবীর সবচে’ অসুন্দর দৃশ্য হলো লোভে চকচক করা চোখ। আর সবচে’ সুন্দর দৃশ্য গভীর মমতায় আর্দ্র প্রেমিকার চোখ। তিনি দীর্ঘদিন লোভে চকচক করা চোখ দেখছেন। দেখে দেখে তিনি খানিকটা ক্লান্ত। তবে লোভী মানুষদের একটা ভালো দিক আছে। কোনো লোভী মানুষই আত্মহত্যার কথা ভাবে না। লোভ তাদের বাঁচিয়ে রাখার প্রেরণা জোগায়। তিনি লোভী হলে ভালো হতো, বেঁচে থেকে আনন্দ পেতেন। এখন বেঁচে থেকে কোনো আনন্দ পান না। আনন্দের জন্যে অতি নিম্নস্তরের কিছু কাণ্ড তিনি করছেন। তাতে তেমন লাভ হচ্ছে কি?