এখন তাঁর কোনো পিপাসা হয় নি। তবু ঠিক করলেন আধগ্লাস পানি খাবেন–এতে যদি অস্বস্তি ভাবটা কাটে। তিনি পানির বোতল বের করলেন। ফ্রিজারের উপর দু’টা পানির গ্লাস থাকার কথা-তাই আছে। তিনি গ্লাসে মেপে মেপে আধাগ্রাস পানি ঢাললেন। বেশিও না, কমও না।
মেয়েটি বলল, কী খান? মদ?
মোবারক সাহেব সহজ গলায় বললেন, না, পানি খাই।
আমি ভাবছিলাম মদ।
মেয়েটি আবার হাসছে। না, হাসি সুন্দর। ঝনঝনে শব্দটা শুনে ভালো লাগছে।
মোবারক সাহেব কখনো এক চুমুকে পানি খান না। গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দেন। আজ এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে বললেন, তোমার নাম হচ্ছে টেপী, তাই তো?
জ্বি।
শোন টেপী, তুমি বাসায় চলে যাও।
টেপী অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। তার ভুরু কুঁচকে গেছে। এতক্ষণ সে শুয়ে ছিল, এখন আধশোয়া হয়ে বসল।
বাসায় চলে যাব?
হ্যাঁ।
আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
রাগ করি নি। তুমি কাপড় পর, কাপড় পরে বাসায় চলে যাও।
এত রাতে বাসায় কীভাবে যাব?
ড্রাইভার আছে। ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দেবে। অসুবিধা হবে না। তুমি থাক কোথায়?
অনেক দূরে থাকি। জয়দেবপুর।
ড্রাইভারকে বললেই হবে।
মোবারক সাহেব লক্ষ করলেন মেয়েটার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন। সে চাদরের নিচেই ব্লাউজ পরার চেষ্টা করছে। ফুলতোলা চাদর দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছে। মেয়েটাকে ভালোমতো কাপড় পরার সুযোগ দেয়ার জন্যেই তার এ ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। তিনি গেলেন না। এদের প্রশ্ৰয় দেয়ার কোনো কারণ নেই। স্ট্রিটগার্লদের স্ট্রিটগার্লের মতোই ‘ট্রিট’ করা উচিত। মেয়েটাকে অবশ্যি স্ট্রিটগার্লের মতো দেখাচ্ছে না। ভদ্র পরিবারের আহ্লাদী মেয়ের মতো লাগছে। কে জানে মেয়েটা হয়তো এই জীবনেই সুখী।
তোমার ঐ জয়দেবপুরের বাসায় কে থাকেন? তোমার বাবা-মা?
মেয়েটি চাদর দাঁত দিয়ে চেপে ধরেই কথা বলছে। কথাগুলো অস্পষ্ট এবং জড়ানো শোনা যাচ্ছে। সে বলল, মা থাকে আর আমার ছোট মামা।
বাবা কি মারা গেছেন?
না, বাবা আমাদের সঙ্গে থাকে না।
বোন দু’জন থাকে? হ্যাঁপী এবং পেপী?
হুঁ।
তোমার ভালো নাম কী?
আমার একটাই নাম। আচ্ছা। আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
মোবারক সাহেব জবাব দিতে গিয়েও জবাব দিতে পারলেন না, একটু চমকে উঠলেন। কারণ মেয়েটি চাদর ফেলে দিয়েছে। ব্লাউজ সে ঠিকমতো পরে নি। বোতাম লাগানো হয় নি। ব্লাউজের নিচে কাঁচুলি নেই। গভীর আমন্ত্রণের ছবি। সে বলল, এত রাতে বাসায় গেলে আমার খুব অসুবিধা হবে। আমি বলে এসেছি। সারারাত শুটিং।
মোবারক সাহেবের মনে পড়ল–এই মেয়ে ছবিতে কাজ করে। এক্সট্রা। মূল নায়িকার সঙ্গে নাচে কিংবা গান গায়। নায়িকা যখন পুকুরে নেমে জলকেলি করে তখন সেও সঙ্গে থাকে। নায়িকার ভেজা শরীরের সঙ্গে তার ভেজা শরীরও দেখা যায়। এই মেয়েটির ভেজা শরীর নিশ্চয়ই নায়িকার শরীরের চেয়ে অনেক সুন্দর।
তোমার হাতে এখন যে ছবি তার নাম কী?
প্রেম দেওয়ানা।
ছবিতে তুমি যে চরিত্রটা করছি সেটা কি নায়িকার সখী?
উঁহুঁ—আমি খারাপ লোকদের আস্তানার একজন বাইজী।
গান গাও, না নাচ?
নাচি।
নাচ জান?
না। ড্যান্সমাস্টার আছে, শিখিয়ে দেয়। ঐগুলা নাচ না–হাত-পা নাড়া।
মোবারক সাহেব লক্ষ করলেন মেয়েটার কথা শুনতে তার ভালো লাগছে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে এত কথা তিনি কারো সঙ্গে বলেন নি। আজ বলে ফেলেছেন। কথা বলতে ভালো লাগার কারণ কি? মেয়েটির গলার স্বর অস্বাভাবিক সুন্দর এটা একটা কারণ হতে পারে। দ্বিতীয় কারণটা স্থূল। খোলা ব্লাউজে মেয়েটি যে ভঙ্গিতে বসে আছে সে ভঙ্গিটা দেখতে ভালো লাগে। মোবারক সাহেবের মনে হলো পুরুষ প্রলুব্ধ করার এই ভঙ্গিটা মেয়েটি আগেও ব্যবহার করেছে। এটি তার বহু ব্যবহৃত কৌশল।
আপনি কি আমার নাচ দেখবেন?
নাচ।
আপনার ঘরে নাচের বাজনা আছে না? ইংরেজি বাজনা।
তুমি তো নাচ জান না। বাজনা থাকলে কী হবে? তাছাড়া নাচ দেখতে আমার ইচ্ছা! করছে না। তুমি কাপড় পর। কাপড় পরে চলে যাও।
সারারাত শুটিঙের কথা বাসায় বলে এসেছি।
বলবে শুটিং ক্যানসেল হয়ে গেছে। তোমাদের শুটিং ক্যানসেল হয় না?
হয়। আমরা বলি প্যাকআপ।
বাসায় গিয়ে তাই বলবে। বলবে শুটিং প্যাকআপ হয়েছে।
আচ্ছা আমি বলব। এখন আপনি অন্য ঘরে যান। আমি শাড়ি পরব।
অন্য ঘরে যেতে হবে না। আমার সামনেই পায়।
আপনার সামনে আমি পরব। কেন? আপনি কি আমার স্বামী?
মেয়েটি কঠিন গলায় কথাগুলো বললেও তার মুখ হাসি হাসি। মোবারক সাহেব ঘর ছেড়ে গেলেন না। ওয়ারড্রোব খুললেন। হ্যাঁঙারে পাঞ্জাবি ঝুলানো আছে। পাঞ্জাবির পকেটে মানিব্যাগ। মেয়েটিকে টাকা-পয়সা আগেই দেয়া হয়েছে–আরো কিছু দেয়া যাক। তিনি চারটা পাঁচ শ টাকার নোট বের করলেন। এক্সট্রা অভিনেত্রী হিসেবে এই মেয়ে কত রোজগার করে কে জানে।
তুমি যে অভিনয় কর কত পাও?
শিফট হিসাবে পাই। এক শিফটে দু’শ পঞ্চাশ টাকা।
কতক্ষণে এক শিফট?
আধ ঘণ্টায় এক শিফট।
নাও টাকাটা রাখ।
কেন?
খুশি হয়ে দিচ্ছি।
খুশি তো আপনি হন নাই। আপনি বেজার হয়েছেন।
না আমি খুশি, নাও।
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে টাকা নিল। মোবারক সাহেব পাশের ঘরে চলে এলেন। এই কামরা শোবার ঘরেরই এক্সটেনশন। ছোট্ট একটা বসার ঘর। চারটা গদি আঁটা নিচু চেয়ার। একটা লেখার টেবিল। টেবিলের পাশে আরেকটা তাকে পার্সেনাল কম্পিউটারমেকেনটস এল সি থ্রি। এই কম্পিউটার তিনি শুধুমাত্র দাবা খেলার জন্যে ব্যবহার করেন। কম্পিউটারে দাবার উপর খুব ভালো একটা প্রোগ্রাম আছে। ঘরের এক প্রান্তে বইয়ের সেলফ। একগাদা ইংরেজি ভূতের বইয়ে শেলফ ভর্তি। আসবাব বলতে এই।