ছবির কোন ব্যাপার জানতে চান?
সবই জানতে চাই।
কী পরিমাণ টাকা লাগবে তা দিয়ে শুরু করি?
করুন।
ছবির জগতে আপার লিমিট বলে কিছু নেই। কেউ ইচ্ছা করলে একটা ছবি বানাতে পাঁচ কোটি টাকাও খরচ করতে পারে।
আপার লিমিট না থাকলেও লোয়ার লিমিট নিশ্চয়ই আছে?
জ্বি তা আছে। জিনিসপত্রের দাম–আর্টিস্টদের পেমেন্ট যে হারে বেড়েছে তাতে স্যার একটা ছবির পেছেন প্ৰায় এক কোটি টাকা লগ্নি করতে হয়।
এক কোটি টাকায় ছবি হয়ে যাবে?
জ্বি হবে। একটু টাইট বাজেটে করতে হবে। হাত-পা খেলিয়ে করা যাবে না।
হাত-পা খেলিয়ে করতে কত লাগবে?
তার সঙ্গে আরো পঞ্চাশ লাখ যোগ দিন।
বেশ, আমি এক কোটি পঞ্চাশ লাখ খরচ করব।
আজমল তরফদার কিছুটা হকচাকিয়ে গেলেন। কিছু কিছু মানুষের হাতে টাকা আছে তা তিনি জানেন। সেই টাকা কোন পর্যায়ে আছে তা জানেন না। কালো টাকাকে সাদা করার জন্যে অনেকে ছবি করে। এই ভদ্রলোকের কালো টাকার পরিমাণ কত? ধন্যবান ব্যক্তিদের গা থেকে একটা আলগা চাকচিক্য ঝিলিক দেয়, ইনার তা নেই। সাদামাটা চেহারা–মুখের চামড়ায় ভাজ। পায়জামা পাঞ্জাবি পরে থাকায় স্কুল টিচার স্কুল টিচার বলে মনে হচ্ছে।
স্যার আপনি কী ধরনের ছবি করতে চান? কমার্শিয়াল ছবি, না। আর্ট ছবি?
পার্থক্য কী বুঝিয়ে বলুন।
মানিকদার ছবি হলো–আর্ট ছবি।
মানিকদাটা কে?
সত্যজিত রায়। টালীগঞ্জে একটা ছবি করতে গিয়েছিলাম, তখন উনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
ও আচ্ছা।
‘পথের পাঁচালী’ টাইপ ছবি হলে নাম হবে, তবে হলে ছবি চলবে না। ইন্টারভ্যালের আগেই দর্শক বের হয়ে চলে আসবে। লগ্নি করা টাকা উঠে আসবে না। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া যাবে। বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবি যাবে, ছবির সঙ্গে সঙ্গে ছবির প্ৰযোজক হিসেবে আপনিও যাবেন। এই পর্যন্তই…
আজমল তরফদারের কথার মাঝখানেই শরবত চলে এল। বড়ো সাইজের গ্লাসঈষৎ সবুজাভ রঙের পানীয়, উপরে বরফের টুকরা ভাসছে। শরবত এসেছে। একজনের জন্যে। মোবারক সাহেব বললেন, নিন শরবত নিন।
আপনি খাবেন না স্যার?
জ্বি না। আর্ট ছবি সম্পর্কে তো বললেন, এখন কমার্শিয়াল ছবি সম্পর্কে বলুন।
বলার কিছু নেই স্যার। ধুমধাড়াক্কা টাইপ ছবি। নাচ-গান-যৌনতা, যাত্রা ঢঙের অভিনয়, কিছু ভাঁড়ামি, কিছু চোখের পানি … বারমিশালি খিচুড়ি।
লোকজন খিচুড়ি খাচ্ছে?
না খেলে এত ছবি বানানো হবে কেন? খিচুড়ি খাচ্ছে। যারা সিনেমা হলে যাচ্ছে তারা খিচুড়ি ছাড়া অন্য কিছুই খাবে না।
ছবি বানানো হচ্ছে কাদের জন্যে?
রিকশাওয়ালা, গ্রামের চাষী, কুলি, মজুর। এদের জন্যে–এদের বাড়িতে টিভি নেই, বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই–সারাদিন পরিশ্রম করে সিনেমা হলে এসে সিটি বাজিয়ে একটু আরাম পায়। ছবি বানিয়ে ব্যবসা করতে হলে এদের জন্যে ছবি বানাতে হবে। এখন স্যার ঠিক করতে হবে। আপনি কাদের জন্যে ছবি বানাবেন?
আমি ব্যবসায়ী মানুষ। দেড় কোটি টাকা যখন আমি ইনভেষ্ট করব তখন আশা করব। তিন কোটি টাকা প্ৰফিট।
অবশ্যহ করবেন।
এখন আপনি বলুন আমার এই ছবি পরিচালনা করতে আপনি কত টাকা নেবেন?
আমার এখন পর্যন্ত কোনো ছবি নরম যায় নি। সব ছবি ব্যবসা করেছে। লাস্ট তিনটা ছবির তিনটাই সুপারহিট হয়েছে। আগে আমি তিন লাখ করে নিতাম। লাস্ট দু’টা ছবিতে সাত লাখ নিয়েছি। আপনিও তাই দেবেন।
শরবত খেতে কেমন লাগল?
আজমল তরফদার একটু হকচাকিয়ে গেলেন। হঠাৎ শরবতের প্রসঙ্গ চলে এল কেন বুঝতে পারলেন না।
শরবত খুব ভালো লেগেছে। ঝঁজ আছে।
রেসিপিটা হচ্ছে–এক জগ পানিতে এক ছটাক তেঁতুল এবং এক টেবিল চামচ সৈন্ধব লবণ, কুচিকুচি করে কাটা দু’টা কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, কয়েক দানা জিরা চব্বিশ ঘণ্টা না নেড়ে রেখে দিতে হবে। চব্বিশ ঘণ্টা পর ছেকে আলাদা করতে হবে। তার সঙ্গে পরিমাণ মতো চিনি মিশিয়ে আধা পেগ ভদকা দিতে হবে।
এর মধ্যে ভদকা আছে?
হ্যাঁ সামান্য আছে, আধা পেগেরও কম। আপনি মদ্যপান করেন না?
তেমন অভ্যোস নেই। মাঝেমধ্যে হঠাৎ … ছবির আলাপটা স্যার শেষ করি। আমার আরো কিছু জরুরি কাজ আছে।
মোবারক সাহেব শান্ত গলায় বললেন, ছবির আলাপ অবশ্যই শেষ করবেন–আমি একটু শুধু ইন্টারফেয়ার করব–আপনি যে বললেন সাত লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেন; শেষ দু’টা ছবিতে তাই নিয়েছেন তা তো ঠিক না। আমি খোঁজখবর নিয়েই কথা বলার জন্যে আপনাকে ডেকেছি। এখন পর্যন্ত কোনো ছবিতেই আপনি তিন লাখ টাকার বেশি পারিশ্রমিক পান নি। শেষ ছবিতেই চার লাখ টাকায় কনট্রাক্ট সাইন করেছেন। পেয়েছেন দুলাখ। দু লাখ এখনো পান নি। না পাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। আমি একজন ব্যবসায়ী, দেড় কোটি টাকার একটা প্রজেক্টে হাত দেব–ভালোমতো খোঁজখবর না করেই এগুব তা ভাবলেন কীভাবে? আপনি কি আরেক গ্লাস শরবত খাবেন?
জ্বি স্যার খাব।
এখন বলুন ছবি শেষ করতে আপনার কতদিন লাগবে?
আজমল তরফদারের চিন্তাভাবনা একটু এলোমেলো হয়ে গেছে। স্কুল টিচারের মতো দেখতে এই লোক সহজ লোক না। কঠিন লোক। কঠিন লোকের হয়ে কাজ করায় আনন্দ আছে। এরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়।
আজমল তরফদার আরেকটা ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করছেন। দ্বিতীয়বার শরবতের কথা তাকে বলা হয়েছে কিন্তু খবরটা ভেতরে দেয়া হয় নি। তারপরেও আজমল তরফদারের ধারণা যথাসময়ে শরবতের গ্লাস চলে আসবে। যদি আসে তাহলে ধরে নিতে হবে মোবারক হোসেন নামের এই লোক শুধু কঠিন ব্যক্তি না–সূক্ষ্ম চালের ক্ষমতা আছে এমন এক ব্যক্তি।