ও তো নায়িকা না যে নামের বাহার থাকবে। ও হচ্ছে অতি নগণ্য এক্সট্রা মেয়ে। পোস্টারে এদের নাম যায় না, পর্দায় টাইটেলেও নাম যায় না। কাজেই এদের নাম টেপী হোক বা নীলাঞ্জনা চৌধুরী হোক কিছুই যায় আসে না।
তারপর বল।
কী বলব?
টেপী সম্পর্কে কী বলতে চাচ্ছিলে বল।
ও আচ্ছা–ওরা তিন বোন–হ্যাপী টেপী, পেপী। টেপী মেজ। ফিল্মে কাজ করে সে তার সংসার চালায়, মাঝে মাঝে তাকে অন্য কিছুও করতে হয়। অন্য কিছুটা কী তুমি বুঝতে পারছি?
মনে হয় পারছি।
যাক, তোমার বুদ্ধি তাহলে আমার চেয়ে বেশি। আমাকে প্রথম যখন টেপী বলল, মাঝে মাঝে আমি অন্য কিছু করি–তখন আমি বুঝতে পারিনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, অন্য কিছু কী করা? সে তখন দু’হাতে মুখ ঢেকে এমন কান্না শুরু করল!
মেয়েটির সঙ্গে তোমার কি খুব ভাব?
খুব ভাব না। মোটামুটি ভাব। ফিল্ম লাইনে কারো সঙ্গেই খুব ভাব হয় না। আজ হুট করে তোমার এখানে আসার কারণ কী জান? কারণ হলো টেপী।
বুঝলাম না–বুঝিয়ে বল।
আজ মর্নিং শিফটের শুটিং হঠাৎ করে প্যাকআপ হয়ে গেল। টেপী বলল, আপা চল ক্যান্টিনে চা খাই।
তোমাকে আপা ডাকে? বয়সে তোমার ছোট?
সমানই হব। তবু কেন জানি আপা ডাকে। যাই হোক। ওর সঙ্গে চা খেতে গিয়েছি সেখানে হঠাৎ সে এমন কান্না শুরু করল…।
কেন?
জানি না কেন? আমি জিজ্ঞেস করি নি। আমার এত মন খারাপ হলো–ভাবলাম তোমার কাছে এলে হয়তো মন ভালো হবে।
মন ভালো হয়েছে?
প্রথমে হয়েছিল। এখন আবার মন খারাপ লাগছে।
কেন?
মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। এই জন্যে। আমি একবার ওকে তোমার কাছে নিয়ে আসব।
আমার কাছে কেন?
কোনো কারণ নেই, এমনি আনিব। তোমার টিফিন কেরিয়ার, বাটি এইসব ধুয়ে দিচ্ছি–পানি কোথায় বল তো? নিচে যেতে হবে?
তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। তুমি চুপ করে এখানে বসে থাক।
আমি পা তুলে চুপচাপ বসে থাকব। আর তুমি পুরুষ মানুষ হয়ে থালাবাসন ধুবে–ভাবতেও ঘেন্না লাগছে।
ঘেন্না লাগার কিছু নেই–বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর; অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
থালাবাসন ধোয়া এমন কিছু মহান সৃষ্টি না।
বিশ্বে যা কিছু সাধারণ সৃষ্টি চিরকল্যাণকর; থ্রি-ফোর্থ তার করিয়াছে নারী ওয়ানফোর্থ তার নর।
মবিন হো-হো করে হাসছে। তার সারা শরীরে আনন্দ ঝলমল করছে। মিতুর চোখ ভিজে উঠছে। কেন ভিজে উঠছে সে নিজেও জানে না। মবিনকে এই চোখের পানি দেখতে দেয়া যাবে না। তাকে মুখ ঘুরিয়ে বসতে হবে। এই ঘরের কোনো জানালা নেই, জানালা থাকলে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো যেত। ভেজা চোখ নিয়ে আকাশ দেখতে ভালো লাগে।
মোবারক সাহেবের খাস কামরা
অফিসে মোবারক সাহেবের দু’টা খাস কামরা। একটা হলঘরের মতো বিশাল। ওয়াল টু ওয়াল ধবধবে সাদা কর্পেটে মোড়া। এক কোণায় দশ ফুট বাই ছ’ফুটের মেহগনি কাঠের কালো একটা টেবিল। টেবিলের ওপাশে মোবারক সাহেবের নিচু রোলিং চেয়ার। দেয়ালে বেশ কিছু পেইনটিং। পেইনটিঙের ফ্রেমগুলোও কালো মেহগনি কাঠের। ইন্টারন্যাল ডিজাইনার মেঝের সাদা কার্পেটের সঙ্গে কালো ফার্নিচারের একটা কম্বিনেশন করেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন–কম্পোজিশন ইন ব্ল্যাক এন্ড হেয়াইট। এই ঘরে যে চায়ের কাপে চা দেয়া হয় তার রং পর্যন্ত কালো। পিরিচগুলো সাদা।
এই খাস কামরা মোবারক সাহেব সচরাচর ব্যবহার করেন না–তিনি ব্যবহার করেন বাড়ির চিলেকোঠার খাস কামরা। তুলনামূলকভাবে ঘরটা ছোট-তবে কোনো আসবাব নেই বলে ছোট ঘরও অনেক বড় মনে হয়। বসার জন্যে ঘরে ছোট ছোট কাপেট পাতা আছে। ইটালিয়ান পার্লার মার্কেলের মেঝেতে হালকা নীল রঙের কার্পেট। ঘরে কোনো টেবিল নেই–শুধু মোবারক সাহেবের সামনে মারোয়াড়ি দোকানের ক্যাশ বাক্সের মতো ছোট্ট একটা মার্কেলের টেবিল। বড় বড় কাচের জানালায় পর্দা নেই বলেই ছাদের গোলাপ বাগান চোখে পড়ে। সেই বাগান দর্শনীয়।
আজমল তরফদার জুতা পায়ে মোবারক সাহেবের এই ঘরে ঢুকে দারুণ অপ্ৰস্তুত হয়ে গেলেন। মোবারক সাহেব হাসিমুখে বললেন, এত অপ্ৰস্তুত হবার কিছু নেই। জুতা পায়ে অনেকেই ঢুকে পড়ে। আমি নিজেও কতবার ঢুকেছি।
মেঝেতে ময়লা লেগে গেল।
লাগুক না। মেঝের ময়লা পরিষ্কার করা যায়। আসুন, বসুন আমার সামনে। মেঝেতে বসে অভ্যাস আছে তো? চেয়ার-টেবিল আসার পর থেকে বাঙালি মেঝেতে বসা ভুলে গেছে।
আজমল তরফদার এসে বসলেন। তিনি বসে আরাম পাচ্ছেন না। জিনসের প্যান্টে আঁটসাঁট লাগছে। মোবারক সাহেব বললেন, কী খাবেন বলুন?
এক কাপ চা খেতে পারি।
দুপুরে লাঞ্চের আগে চা খেয়ে খিদে নষ্ট করবেন কেন? শরবত খান। তেঁতুলের একটা শরবত আছে–আমার খুব প্রিয়। আপনার পছন্দ হলে রেসিপি দিয়ে দেব।
থ্যাংক য়্যু স্যার।
এখন ছবির বিষয়ে বলুন।
কী বলব স্যার?
আপনাকে নিশ্চয়ই বলা হয়েছে। আমি একটা ছবি বানাতে চাই।
জ্বি লোকমান সাহেব আমাকে বলেছেন।
সেই প্রসঙ্গে বলুন।
আজমল তরফদার কী বলবেন ভেবে পেলেন না। তাঁর প্রচণ্ড সিগারেটের তৃষ্ণা হচ্ছে কিন্তু এই ঘরের যে অবস্থা তাতে মনে হয় না। এখানে সিগারেট খাওয়া যাবে। ভদ্রলোক শরবতের কথা বলেছেন। অথচ কাউকে শরবত দিতে বলেন নি। ভুলে গেছেন বোধহয়। ঠাণ্ডা এক গ্লাস শরবত পেলে ভালোই হতো।